21 C
আবহাওয়া
৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ - নভেম্বর ২৯, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » ফিরে দেখা: ৩৩ বছর আগের ‘ম্যারি এন’!

ফিরে দেখা: ৩৩ বছর আগের ‘ম্যারি এন’!


বিএনএ, ডেস্ক : ৩৩ বছর আগে ১৯৯১ সালের ২২ এপ্রিল মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। ২৩ এপ্রিল সকালের দিকে লঘুচাপ হিসেবে ধরা পড়ে এটি। তখন এটির অবস্থান ছিল আন্দামান সাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর। এরপর থেকে এটি ধীরে-ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।

YouTube player

২৫ এপ্রিল সকালের দিকে এটি নিম্নচাপে পরিণত হয়। ২৭ এপ্রিল সকালে এটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। সেদিন মধ্যরাতেই এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসর হওয়ার সময় এটি আরও শক্তিশালী হয়। ২৮ ও ২৯ শে এপ্রিল এটির তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং এর গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় ১৫৫ মাইলে। রাতের নিস্তব্ধতা এবং অন্ধকার ভেদ করে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় পূরো উপকূলে আঘাত হানে। মুহূর্তে লন্ডভন্ড হয়ে যায় কক্সবাজার, মহেশখালী, কতুবদিয়া, চকরিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, সীতাকুণ্ড ,পতেঙ্গাসহ উপকূলীয় এলাকা। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে।

পুরো উপকূলীয় অঞ্চল পরিণত হয়েছিল মৃত্যুউপত্যকায়। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ ভয়াবহ এই রুপ। পরদিন ৩০শে এপ্রিল বিশ্ববাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ধ্বংসলীলা দেখে। কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব বিবেক। ‘অপারেশন সি অ্যাঞ্জেলস’ নামে বাংলাদেশের দূর্গত মানুষের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশ।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে বাংলাদেশে-র দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা এ ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচচ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বা ১৫৫ মাইল। প্রলয়ঙ্কারী এই ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটা রঅর্থাৎ ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে প্রথম ধাক্কায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা দ্বিগুনেরও বেশি। গৃহহারা হয়েছিল ৫০ লক্ষ মানুষ। শুধু চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেই প্রায় ১২ হাজার মানুষ মারা যায়। দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় প্রাণহানি হয়েছিলো প্রায় ৮ হাজার লোকের। সেখানে নারীর লাশ আটকে ছিল গাছের ওপর। এতে বুঝা যায় কতটা ভয়াবহ ও উঁচু ছিল সেই জলোচ্ছ্বাস।

এই ঘূর্ণিঝড়ে কেউ কেউ বাবা, মা, ভাই বোন এবং আত্মীয়স্বজন সবাইকে হারিয়েছিল। এমন অনেক পরিবার আছে যাদের কেউ প্রাণ বাচাঁতে পারেনি। যারা বেঁচে ছিলেন, তারাও ছিল এক একটি জিন্দা লাশ!

স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে একসাথে এতো মানুষ কখনো মারা যায়নি। যদিও ১৯৭০ সালে উপকূলীয় জেলায় শক্তিশালী এক ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল বলে বলা হয়।

ঘুর্ণিঝড়ে যে কেবল মানুষের প্রাণহানি ও বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছিল তা নয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বিভিন্ন অবকাঠামো এবং যন্ত্রপাতির। এর মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান এবং নৌবাহিনীর জাহাজ। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে পতেঙ্গায় বিমান বাহিনীর অধিকাংশ যুদ্ধবিমান নষ্ট হয়ে যায়। পুরো বিমান বন্দর তলিয়ে যায় অন্তত ৬ মিটার পানিতে।

রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত চারটি বাক্স ভর্তি হেলিকপ্টার জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ভেসে রাস্তার উপর চলে আসে। এ হেলিকপ্টারগুলো ৫০০ গজ দুরে তালাবদ্ধ অবস্থায় হেঙ্গারে ছিল। পানি ও বাতাসের চাপে হেঙ্গার ভেঙ্গে গিয়েছিল। কর্ণফুলী নদী আর এয়ারপোর্ট সব একসাথে পানিতে মিশে যায়। কোনটা এয়ারপোর্ট, কোনটা কর্ণফূলী নদী তা চিহ্নিত করার উপায় ছিল না। জাহাজের ধাক্কায় ভেঙ্গে যায় কর্ণফূলী সেতু।

প্রবল ঘুর্ণিঝড়ের বিপদ সংকেত পাওয়ার পরও বিমান সরিয়ে না নেওয়ায় তৎকালীন বিমান এবং নৌবাহিনীর প্রধানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেন তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাব উদ্দিন আহমেদ।
ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা ছিল এক রকম এবং পরবর্তী সময়ের বিভীষিকাময় রুপ ছিল আরও ভয়াবহ। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিস্তীর্ণ উপকুল জুড়ে ছিল খাবার ও পানির সংকট। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে ছড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের রোগ। এতেও মারা যায়, অসংখ্য মানুষ।

১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল রাতে যে ’ম্যারি এন‘ নামক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল তার পরিচয় TC-02B হিসেবে, তার মানে এটি ছিল ১৯৯১ সালে বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়।

পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৮০ টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর অধিকাংশই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, কিন্ত্ত যে অল্প সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে, ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে, তার একটি ১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝর ম্যারি এন। উপকূলবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি। শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় ও স্বজন হারানোর বেদনায় এখনো কাঁদে উপকূলীয় ১৯ জেলার ১০২ টি উপজেলার মানুষ।

বিএনএ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী

Loading


শিরোনাম বিএনএ