বিএনএ ডেস্ক : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এক সময় সর্বহারাদের রাজত্ব ছিল।সেই রাজত্বের মধ্যে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের উত্থান। আনোয়ারুল আজিম আনারের পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। ১৯৮৪ সালে এমপি আনার এসএসসি পাশ করেছেন। ১৯৮৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। আর সরকারি মাহতাবউদ্দিন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেন ১৯৮৮ সালে।
ছাত্রজীবন থেকে তিনি মাদক, স্বর্ণ. চোরাচালান, খুন খারাবিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। এইচ এম এরশাদের সময় স্বর্ণ চোরাচালান ও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এক পর্যায়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যান। মাইক্রোবাসে করে ঢাকা বিমানবন্দর এলাকা থেকে স্বর্ণ নিয়ে যেতেন সীমান্তবর্তী এলাকায় আর মাদক নিয়ে আসতেন ঢাকায়। আনারের এলাকায় তার একক আধিপত্য ছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমপি আনার ছাত্রজীবন থেকে ২৩টি মোটরসাইকেল নিয়ে চলতেন। নিজে চালাতেন লাল রঙের একটি মোটরসাইকেল। অন্য ২২টি মোটরসাইকেলে চোরাচালানের সামগ্রী বহন করত তার নিয়োজিত কর্মীরা। তারা ছিল বেতনভুক্ত। চোরাচালান করতে গিয়ে আনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে টাকা দিতেন।
ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্তপথে চোরাচালান করতেন তিনি।
ঐ সময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী। ঐ টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত।
এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও বনে যান। আনারের স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানি করে অনেক শ্রমিক ও দিনমজুরের ছেলেরা এখন হাজার কোটি টাকার মালিক।
এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনার। অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাহিরে থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান। মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের কারবারের পাশাপাশি কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারেও জড়ান তিনি। তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো।
আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চরমপন্থিদের আশ্রয় ও হত্যাসহ ২২টি মামলা ছিল।
১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমে কালিগঞ্জ পৌর মেম্বার ছিলেন। ওই সময় জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে দুই বার মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। মুলত: চোরাচালানে সুবিধা ভোগের জন্য বারবার দল বদল করেছে আনার।
প্রসঙ্গত, চরমপন্থি লাল দলের প্রধান বলে পরিচিত রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ডা. টুটুলকে ২০০৯ সালে র্যাব তুলে নিয়ে যায়। নেওয়ার পরদিন তার লাশ পাওয়া যায় নওগাঁওয়ের গোদাগাড়ি এলাকায়। ঐ সময় তার পরিবার সন্দেহ করেছিল, এমপি আনার লাল দলের প্রধান ডা. টুটুলকে র্যাবের হাতে তুলে দিতে সহযোগিতা করেছিলেন। নিহত টুটুল হলেন এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী শাহীনের আপন চাচাতো ভাই। আর এমপি আনার হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়ার আপন ভগ্নীপতি। এই কারণে শাহীন ও শিমুল আগে থেকেই এমপি আনারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। শিমুলকে র্যাব দিয়েও মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন আনার। সে পালিয়ে নিজেকে বাঁচায়। শাহীন ও শিমুলের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল আনারের ওপর। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের পেছনে ডা. টুটুল হত্যাকাণ্ডও একটি কারণ।
আনারকে গ্রেপ্তারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। এর ১০ দিন পর ঐ বছরের ২১ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তারের জন্য নিশ্চিন্তপুর গ্রামে তার বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার এমপি আনারকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ঐ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনার। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০০৯ সালে আনার উপজেলা চেয়ারম্যান হন। ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েক জন মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্ষমতার পাশাপাশি চোরাচালানের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। আর সেই অর্থ সম্পদের ভাগবাটোয়ারা নিয়েই শেষ পর্যন্ত বন্ধু শাহীনের পরিকল্পনায় কসাইয়ের হাতে ৮০ টুকরো হয়ে জীবন দিতে হলো তাকে। শুধু তাই নয়, সেই খন্ডিত লাশের কোন অংশই পাওয়া যায়নি।
বিএনএনিউজ/শামীমা চৌধুরী শাম্মী/এইচ.এম/এইচমুন্নী