।। মৃন্ময় মন্ডল তুষার ।।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বর্তমান সময়ের বহুলব্যবহৃত ও আলোচিত একটি বিষয়। গত কয়েক বছরে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ শব্দ দুটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিভিন্নভাবে পরিচিত হয়েছে। আর বিভিন্ন বয়স, শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন আবেদন ও অনুভূতি নিয়ে আজ এক মিশ্র অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে এই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ধারণাটি। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে এই স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণা। নানা গুণীজন নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে আলোচনা করার চেষ্টা করেছেন স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণাকে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে চারটি স্তম্ভ নির্ধারণ করা হয়েছে। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট, এই চার স্তম্ভের উপর স্বগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হবে আমাদের স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ।
বর্তমানে বিশ্বে চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ। দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে দ্রুত গতির যোগাযোগব্যবস্থা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) সংবলিত মেশিন ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি বা ডিভাইস, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারের (থ্রি-ডি প্রিন্টার) ব্যবহারে স্বল্প সময়েই অধিক যন্ত্রপাতি তৈরি-সহ নানা অত্যাধুনিক সুবিধা নিয়ে মানুষের জীবনকে আরও দ্রুত, কর্মদক্ষতায় পরিপূর্ণ ও গতিশীল করতে শুরু হয়েছে এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। আর এই শিল্পবিপ্লবের সাথেই তাল রাখতে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ১২ই ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
স্মার্ট বাংলাদেশের সিটিজেন বা নাগরিকেরা হবেন স্মার্ট। তবে এই স্মার্ট নাগরিক বলতে সুন্দর চাকচিক্যময় পোশাক পরা, চোখে কালো চশমা পরে ব্যাপক সাজগোজ করা নাগরিক বোঝায় না। স্মার্ট নাগরিক বলতে বুঝায়, যিনি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিজের কাজ সাধন করতে পারবেন; যিনি সরকারি সেবা নিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে পারদর্শী হবেন এবং অন্যদেরও নিজের মতো স্মার্ট হতে সাহায্য করবেন। স্মার্ট নাগরিক নিজের করণীয় বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকবেন এবং স্মার্ট পদ্ধতিতে কীভাবে সরকারি-বেসরকারি সেবা গ্রহণ করতে হয়, সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখবেন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারে স্মার্ট নাগরিক পারদর্শী হবেন এবং কম সময়ের মধ্যেই নিজের কাজ করতে সক্ষম হবেন।
স্মার্ট বাংলাদেশের ইকোনমি বা অর্থনীতিও হবে স্মার্ট। বিষয়টা এমন নয় যে, এই অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ব্যাপক চাকচিক্যময় হবে বা ব্যাপক সাজগোজ করে নাগরিকেরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবেন। স্মার্ট অর্থনীতি বলতে বুঝায়, এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম সময়ে বেশি কাজ নির্ভুল, ঝামেলাহীন ও ঝুঁকিহীনভাবে করা যায়। ধরুন, যেকোনো ধরনের লেনদেনে ধাতব বা কাগজের মুদ্রার পরিবর্তে ইলেক্ট্রনিক ক্যাশ সিস্টেম (যেমন : বিকাশ, নগদ, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড) ব্যবহার করা হলো স্মার্ট অর্থনীতির একটি দিক। আবার ব্যাংকে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে না দাঁড়িয়ে মোবাইল অ্যাপ দিয়ে টাকা লেনদেন করাও স্মার্ট অর্থনীতির আরেকটি দিক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে অল্প সময়ে অধিক উৎপাদনশীল, পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক এক অর্থনীতিই মূলত স্মার্ট অর্থনীতি।
স্মার্ট বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থাও হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী এক সরকার ব্যবস্থা, যেখানে সরকার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের কাছে আরও সুন্দর ও সহজভাবে সেবা পৌঁছে দেবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। স্মার্ট সরকারের নিজস্ব অবকাঠামো ও কর্মপরিকল্পনাতেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ছোঁয়া থাকবে। ইতোমধ্যেই সরকারি অফিসের সকল ধরনের নথিভিত্তিক কাজ করার জন্য চালু করা হয়েছে ‘ডি-নথি’ সিস্টেম, যেখানে শুধু ইন্টারনেটের সংযোগ থাকলেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে একজন সরকারি কর্মচারী কাজ করতে সক্ষম। আবার জনগণের সেবা সহজীকরণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই চালু করেছে ‘মাই গভ’ নামক ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপভিত্তিক সেবা, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই একজন নাগরিক পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারবেন। কাজেই যদি কেউ কল্পনা করেন, স্মার্ট সরকার বলতে ব্যাপক সাজগোজ করা সরকারি কর্মচারী-পরিবেষ্টিত সরকারব্যবস্থা, তাহলে সেই চিন্তা বাস্তবসম্মত নয়।
আর এই স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে সেটাই হলো স্মার্ট সোসাইটি বা স্মার্ট সমাজ। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট সমাজে কৃষক আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও স্মার্ট পদ্ধতিতে চাষাবাদ করবে, মাছ চাষ করবে, হাঁস-মুরগি ও পশুপালন করবে। কৃষি উৎপাদন, বিপণন ও বাজার ব্যবস্থায় থাকবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লক-চেইন প্রযুক্তি-সহ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নানা প্রযুক্তির ছোঁয়া। স্মার্ট সমাজের শিল্পব্যবস্থা হবে কম সময়ে অধিক উৎপাদনশীল ও পরিবেশবান্ধব। স্মার্ট বাংলাদেশের সেবাব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কে কত সহজে, কত দ্রুত সেবা প্রার্থীর কাছে সেবা নিশ্চিত করবে, তা নিয়ে। স্মার্ট সমাজে গড়ে উঠবে স্মার্ট উদ্যোক্তা, যারা নিজেরাও স্মার্ট নাগরিক হবেন, স্মার্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্মার্ট সমাজ গড়ে তুলতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখবেন। মূলত স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজব্যবস্থা প্রত্যেকটি একে অন্যের উপর নির্ভরশীল ও পরিপূরক। আর এ চারটি স্তম্ভের সমন্বয়েই গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ।
ইতোমধ্যেই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে অদম্য গতিতে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ ভিশন বাস্তবায়ন করতে সরকার ১৪টি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আওতায় প্রধান অঙ্গ হবে স্মার্ট শিক্ষা, স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট বাণিজ্য, স্মার্ট পরিবহণ ইত্যাদি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ গঠন করা হয়েছে, যার বাস্তবায়নে রয়েছে সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ। ২০২১ সালের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে ২০৪১ সালের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর অগ্রযাত্রা কেমন হবে, কী কী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে, তার জন্য সরকার গ্রহণ করেছে ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১’। ইতোমধ্যেই সরকারের প্রায় প্রতিটি দপ্তর নিজস্ব ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ-এর মাধ্যমে নাগরিকদের জন্য বেশ কিছু সরকারি সেবা নিশ্চিত করেছে। আর সরকারি দপ্তরগুলোও প্রতিনিয়ত আধুনিক ফিচার-সংবলিত সেবা প্রদানের মাধ্যম স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকারের প্রচার মাধ্যমগুলোও জনগণের মাঝে স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণাকে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন স্মার্ট কর্মসূচি ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছে।
বিশ্বমানের আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে ইতোমধ্যেই দেশে গড়ে উঠেছে ৩৯টি হাইটেক পার্ক। এগুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও স্মার্ট বাংলাদেশের এই জোয়ারে দেশকে নানা নাগরিকবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তির সৃষ্টিকর্ম উপহার দিতে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের ৬৪টি জেলা ও ৪৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদকে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। ভূমি নামজারি, জন্মনিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়া, করদাতাদের জন্য ই-টিন সিস্টেম প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সেবা ইতোমধ্যেই ইন্টারনেটভিত্তিক ও স্মার্ট হয়েছে। দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কে ইতোমধ্যেই ৫-জি প্রযুক্তির সূচনা হয়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার বিদ্যমান দুইটি সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যান্ডউইডথ বাড়ানোর পাশাপাশি তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সাথেও সংযুক্ত হয়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বদ্ধপরিকর।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যেও লেগেছে স্মার্ট বাংলাদেশের ছোঁয়া। ইদানীং অনেকেই সরকারি বিভিন্ন সেবা অনলাইনে নিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। টাকার বদলে কার্ড পেমেন্ট মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এম এফ এস) জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিভিন্ন অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের মধ্যে পেপারলেস ফাইল ওয়ার্ক নেটওয়ার্কিং সিস্টেম গড়ে তুলছে। রোবটিক্স, বিগ ডাটা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা স্মার্ট প্রযুক্তির পণ্যগুলোও দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
সরকারের লক্ষ্য হলো, এই প্রযুক্তির ছোঁয়াতে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের জীবন সহজ, সুন্দর ও গতিশীল করা। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীতের এক বিষয়। মূল্যস্ফীতি হবে সীমিত, বাজেট ঘাটতি থাকবে ৫ শতাংশের নিচে, রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত হবে ২০ শতাংশের বেশি এবং বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ। স্বয়ংক্রিয় ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি-সংবলিত যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প ও সেবাব্যবস্থার পাশাপাশি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সমাজব্যবস্থাই হবে ২০৪১ সালের আধুনিক বাংলাদেশ। আর এভাবেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ অর্জন করবে স্মার্ট বাংলাদেশের মর্যাদা। প্রধনামন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বপ্নের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনিমার্ণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য ও দুর্বার গতিতে। (পিআইডি ফিচার)
লেখক : সহকারী পরিচালক (অনুষ্ঠান), বাংলাদেশ বেতার, রংপুর