।। হাবিবুর রহমান।।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর লাল পাহাড়ের সবুজ ক্যাম্পাস নামে খ্যাত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় । ২০০৬ সালের ২৮ মে দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। কুমিল্লা শহর থেকে ৯ কি.মি পশ্চিমে কুমিল্লার ময়নামতি সংলগ্ন লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে প্রকৃতির আপনকোলে সবুজের অভয়ারণ্যে অবস্থিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭বছর পেরিয়ে ১৮তম বর্ষে পদার্পণ করেছে লাল পাহাড়ের সবুজ ক্যাম্পাস।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ২৬ তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে মাত্র ৫০ একরের মাঝে। বর্তমানে এর পরিধি বাড়িয়ে ২০০ একর করা হয়েছে। ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে ৭ বিভাগ, ৩০০ শিক্ষার্থী, ১৫ শিক্ষক ও ৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে চালু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৬ অনুষদের অধীনে ১৯ বিভাগ, ২৬৫ শিক্ষক, ৩০৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্যসহ ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। মুক্তজ্ঞান চর্চার জন্য রয়েছে মুক্তমঞ্চ, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, কাঁঠাল তলা, বৈশাখী চত্বর, লালন চত্বর, মুক্তমঞ্চ, বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য, প্রেম সেতু, সানসেট ভ্যালি, ক্যাফেটেরিয়া, শহীদ মিনার, জিরো পয়েন্ট, ভিসি টং ও পাবলিকেড চত্বর। এছাড়াও আছে ক্যাফেটেরিয়া, ব্যায়ামাগার এবং নামাজ আদায়ের জন্য কেন্দ্রীয় মসজিদ। এ স্থানগুলোতে প্রতিনিয়ত জমে উঠে আড্ডা ও গানের আসর যা ক্যাম্পাসটিকে দান করেছে পূর্ণতা।
বিশ্ববিদ্যালয়টি ৫০ একর ভুমির উপর স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিশাল আকাশের পানে। এর কোলঘেষে রয়েছে নব শালবনবিহার, শালবন, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ, ময়নামতি জাদুঘর এবং সামাজিক বনায়ন। প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। তাছাড়া আগত শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন মন-মানসিকতা একই বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক হাস্য-উজ্জ্বল পরিবেশের জন্ম নেয়। তাদের মাঝে গড়ে উঠে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, আড্ডা, হাসি,গান ও বিভিন্ন ধরণের নাট্যাভিনয়। সবকিছু মিলিয়ে তারা এক নতুন জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের উপযোগী করে তোলে।
লাল পাহাড়ের সবুজে ঘেরা মনোমুগ্ধকর ক্যাম্পাসটির পরিবেশ সবাইকে নব-স্বপ্নে জেগে তোলে। যার ফলে নতুন নতুন স্বপ্নের সঞ্চার হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে। বিশাল দানবের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন গুলোর ছাদের উপরে উঠলে মনে হয় পাহাড়ের পর পাহাড় আবার পাহাড় যেন বিচলিত সংখ্যাতীত তরঙ্গ। এছাড়া কৃষ্ণচূড়া ফুলে ঢেকে থাকা সারি সারি বৃক্ষরাজি দেখে মনে হয় নব-বধূর নবরূপে সজ্জিত অনিন্দ্য সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। যার অপরূপ সৌন্দর্যতা সকলের মন কেড়ে নেয়। লাল পাহাড়ের সবুজ ক্যাম্পাসের মুগ্ধতায় হাজার হাজার দর্শনার্থী ছুটে আসে অনিন্দ্য সুন্দরের লীলাভূমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে মোট ৫টি আবাসিক হল। ছাত্রদের জন্য ৩টি, ছাত্রীদের জন্য রয়েছে ২টি । এছাড়াও শিক্ষকবৃন্দ ও কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে ২টি ডরমেটরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো হলো বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান হল, কাজী নজরুল ইসলাম হল, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল, নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হল এবং শেখ হাসিনা হল।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মোকাদ্দেস-উল-ইসলাম বলেন, বিগত ১৭ বছরে আমাদের গর্ব করার মত সাফল্য অনেক আছে। তবে আমরা মনে করি, কয়েকটি দিকে আমাদের সকলের মনযোগী হওয়া উচিত। প্রথমত, সার্টিফিকেট অর্জনের চেয়ে নির্দিষ্ট বিষয়াবলি শিখে যোগ্যতম হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যে প্রবণতার খুব অভাব। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব বা স্বর তৈরি হচ্ছে না, যেটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখানোর কাজটা করবে। সবাই কেমন যেন অন্যের ভাষায় কথা বলে, অন্যকে খুশি করার জন্য ব্যস্ত থাকে, যা কাম্য নয়। তৃতীয়ত, পরোপকারী মানসিকতার অভাব। সবাই কেমন আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত। ব্যষ্টির চেয়ে সামষ্টিক প্রয়াস ও হিতবাদিতার সমন্বয় দরকার। এই তিনটির সুষম মিশ্রণে তৈরিকৃত গ্রাজুয়েট দেশ ও দশের সম্পদে পরিণত হবে এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় তার কাঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবস নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দীন বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন আমরা আর নবীন বিশ্ববিদ্যালয় বলব না, আমরা প্রতিযোগিতার বাজারে নেমে পড়েছি। ২০০৬ সালে আমরা নবীন বিশ্ববিদ্যালয় ছিলাম কিন্তু এই নবীনের তকমা নিয়ে আমরা আর কতদিন থাকবো। হাটি হাটি পা পা করে আমরা ১৮ তে চলে এলাম। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো উচিত। কারণ যারা আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়কে লিড দিবে তাদেরকে যদি ভালমতো গড়ে তুলতে না পারি সেক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য আসবেনা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেতে বলব, আমরা এখন আর নবীন নয়, আমরা প্রতিযোগিতার বাজারে নেমে পড়েছি। বিগত চার-পাঁচ বছরে শিক্ষকরা গবেষণা থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী যে অবদান রেখে চলেছে তাতে শিক্ষকদের গুনগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইভাবে আমাদের শিক্ষার্থীরাও প্রতিটি ক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি যেসব বিষয় অন্যান্য শিক্ষামূলক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত সেগুলো হল থিয়েটার, প্রতিবর্তন, অনুপ্রাস, রোভার স্কাউট, বিএনসিসি,সায়েন্স ক্লাব, বন্ধু,অনুস্বার,মুকুল, আইটি সোসাইটি এবং প্লাটফর্ম। আছে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের সংগঠন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (কুবিসাস)। এসব সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি মানসিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। যার কারণে আজ প্রত্যেক শিক্ষার্থী উন্মুক্ত পরিবেশে নিজেকে একজন যোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে।
বিএনএ/ ওজি