বিএনএ, ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়ার সিমান্ত এলাকায় পাহাড় থেকে খাবারের সন্ধানে নেমে আসা হাতির দলের সাথে চলছে মানুষের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বে মাসের ব্যবধানে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, নষ্ট করেছে কয়েক হেক্টর জমির ধান, ভাংচুর করেছে অন্তত ৫০ ঘর৷ একই সাথে ভেঙেছে কলাবাগান ও বেশ কয়েকটি টিউবওয়েল। প্রাণে বাঁচতে গরু ছাগল নিয়ে আত্মীয় বাড়িতে বসবাস করছেন অনেকে।
আবেদন করেও গত দুই বছর ফসল, ঘরবাড়ি ভাঙার কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে দাবি করছেন ভুক্তভোগীরা। আশ্বাসে দিন কাটছে হাতির আক্রমণে ছেলে হারানো মা, বাবা হারানো সন্তানের। বনবিভাগ বলছে, ক্ষতিপূরণ চেয়ে অন্তত ৪০০ আবেদন জমা পড়েছে। জুলাই মাসে ৩০ থেকে ৩৫ টি আবেদনের অর্থ আসতে পারে।
সম্প্রতি জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার গাজিরভিটা ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সুত্র জানায়, গত ২২ এপ্রিল ঈদের দিন ফসল রক্ষা করতে গিয়ে হাতির আক্রমণে মারা যায় ওই ইউনিয়নে কাটাবাড়ি গ্রামের মৃত ফজর আলীর ছেলে ফরজুল (৩৩)। এর ১০ দিন পর মে মাসের ২ তারিখে ফসল রক্ষা করতে গিয়ে হাতির পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা যায় একই ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের মৃত তমিজ উদ্দিনের ছেলে পল্লী চিকিৎসক ইদ্রিস আলী (৫০)। এদিকে, জেলার ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের রাণীপুর গ্রামে হাতির আক্রমণে মারা যায় সুমন আহমেদ (১৫) নামের এক কিশোর। সে ওই এলাকার আব্দুল মোমেনের ছেলে।
কাটাবাড়ি গ্রামে গিয়ে কথা হয় হাতির আক্রমণে নিহত ফরজুল হকের স্ত্রী রুমা আক্তারের সাথে। তিনি বলেন, আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। ঈদের দিন বিকালে হাতির দল এসে আমার ও অন্যান্য কৃষকের ধান নষ্ট করছিল। ফসল রক্ষা করতে সবাই একসাথে হাতি তাড়াতে যায়। হাতি তাড়ানোর কোন একপর্যায়ে ফরজুল হাতির খুব কাছাকাছি চলে যায়। পরে উল্টো হাতির দল তাকে তাড়া করে। সে ফিরে আসতে না পেরে হাতির দলের মাঝখানে পড়ে যায়। এসময় হাতির পদতলে পিষ্ট হয়ে সে মারা যায়।
রুমা আক্তার বলেন, আমার সংসারে তিনি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার মৃত্যুতে দুই সন্তান নিয়ে খুব বিপাকে আছি। কিভাবে সংসার চালাব কিছুই বুজতে পারছি না। তিনি মারা যাওয়ার পর স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ১৫ হাজার টাকা দিয়েছে এবং খোঁজখবর নিয়ে ক্ষতিপূরন হিসাবে আরও ৩ লাখ টাকা দিবে বলেছিলেন। সে জন্য ব্যাংকে একাউন্ট ও আবেদন করতে বলেছিলেন তাও করেছি, কিন্তু এখনো কোন সাড়া মেলেনি। এখন আর কেউ আমাদের কোন খোঁজখবর নেয় না।
কথা হয় একই এলাকার কৃষক জয়নাল মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, গত দুই বছর হাতি আমাদের ব্যাপক ক্ষতি করছে। ঘরবাড়ি ভেঙেছে ও ফসলের অনেক ক্ষতি করেছে। দুই বছর যাবত শুনে আসছি, আমরা ক্ষতিপূরণ পাব।কিছুই পাইনি, আশ্বাসেই আমাদের দিন কাটছে।
একই ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামে হাতির পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন মৃত তমিজ উদ্দিনের ছেলে পল্লী চিকিৎসক ইদ্রিস আলী। তিনি পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। তিনিও নিজের ফসল রক্ষ্যা করতে অন্য কৃষকদের সাথে হাতি তাড়াতে গিয়ে পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা যান।
হাতির আক্রমনে নিহত ইদ্রিস আলীর ছেলে মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি গাজিপুরের স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকায় গার্মেন্টসে চাকরী করেন। তিনি বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে ১০ হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। এছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসে খোঁজখবর নিয়ে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল। এরপর আর কেউ কোন খোঁজখবর নেয়নি।
তিনি বলেন, বনবিভাগের লোকজন বলেছিলেন ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৩ লাখ টাকা দিবে। সেই অনুযায়ী আবেদন করেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সাড়া মেলেনি। আমার বাবা হাতির আক্রমনে মারা গেছে। বাবা তো আর ফিরে আসবে না। আমি চাই আমার বাবার মত কেউ যেন আর এভাবে প্রাণ না হারায়।
মেয়ে উম্মে কুলসুম বলেন, আমার বাবা কৃষি কাজ করার পাশাপাশি পল্লী চিকিৎসা দিয়ে আয় রোজগার করে সংসার চালাত। বাবা মারা যাওয়ায় সংসারে অভাব অনটন নেমে এসেছে। বাবা মারা গেছে, বাবা তো আসবে না। আমাদের দাবি সরকার যেন আমার ভাইকে একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দেয়।
তিনি বলেন, প্রতিদিন হাতি দল বেঁধে এসে ফসল, ঘরবাড়ির ক্ষতি করে, মানুষও মেরে ফেলছে। চরম আতঙ্কে আমাদের দিন কাটে। হাতি যেন আসতে না পারে, সরকার তার ব্যবস্থাও করছে না। আবার হাতিকে মারাও যাবে না, মারলে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, মামলাও করবে। আমার বাবাকে হাতি মেরে ফেলছে, আমার বাবা কি আর ফিরে আসবে।
একই ইউনিয়নের লামছাপাড়া গ্রামের বাহেন্দ্র চিরান বলেন, এই বছর হাতির আক্রমন শুরু হওয়ার পর থেকে রাতে বাড়িঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় বসবাস করি। এই বছর আমার ঘরে রাখা ১০ মন চাল নষ্ট করছে, ৫০ শতাংশ জমির ধান নষ্ট করছে, আমাদের কয়েকটা পানির টিউবওয়েল ছিল, এগুলো সব হাতি উপরে ফেলছে। আমাদের গ্রামের ১২টি ঘর ভাঙছে, পাশের গ্রামেও অনেক ঘরবাড়ি ভাঙছে। আর ফসল কত নষ্ট করছে, তার তো হিসাবই নাই। গত দুই বছর যাবত হাতি এভাবে ক্ষতি করছে, তারপরেও সরকার কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
একই গ্রামের বকুল মারাক বলেন, প্রতিদিনই হাতি দল বেঁধে আসে। হাতি আসলেই খাওয়া দাওয়া রেখে দৌড়ে পালাতে হয়। গরু ছাগল তো বাড়িতে রাখা যায় না। আমাদের দাবি, আমরা যেন বাড়িতে থাকতে পারি। হাতির ভয়ে যেন বাড়ি থেকে পালাতে না হয়, সরকার যেন সেই ব্যবস্থা করে।
বনবিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে ৩৫ জন। এই সময়ের মধ্যে মানুষের হামলাসহ নানা কারণে ৩০টি হাতিও মারা গেছে। ২ হাজারের অধিক হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে আরও ২ হাজার। সরকার ৯ বছরে প্রায় ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।
চার জেলার ১৬০ কিলোমিটারের মতো সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্তের করিডর দিয়ে ভারতের মেঘালয় থেকে শতাধিক বন্য হাতি বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। হাতির প্রবেশ বন্ধে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শেরপুরের ঝিনাইগাতী সীমান্তে ১৩ কিলোমিটার সৌরবিদ্যুতের ফাঁদ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেখানে আরও আট কিলোমিটার সৌরবিদ্যুতের ফাঁদ নির্মাণের কাজ চলমান। গোপালপুরে দুই কিলোমিটার সৌরবিদ্যুতের ফাঁদ নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ২৫ কিলোমিটার সৌরবিদ্যুতের ফাঁদ নির্মাণের পাশাপাশি সীমান্তে কাঁটাযুক্ত গাছ লাগানোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
গাজিরভিটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মান্নান বলেন, গত কয়েক দিনে আমার ইউনিয়নে হাতির আক্রমণে দুজন মারা গেছেন।আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমরা চাই, সরকার যেন দ্রুত সীমান্ত এলাকায় ফাঁদ বসিয়ে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করে।
হালুয়াঘাট উপজেলা৷ নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান বলেন, সীমান্ত এলাকায় হাতির আক্রমণে ক্ষতিপূরণ বা অন্য যে কোন বিষয় বনবিভাগ দেখাশোনা করে। আমরা শুধু আবেদন নিয়ে বনবিভাগের কাছে পাঠিয়ে দেই।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, হাতির আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতির ৪০০ আবেদন পেয়েছি। সবগুলোই পাঠানো হয়েছে। এই অর্থবছরে ৩০ থেকে ৩৫ টি আবেদনের ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া যেতে পারো। এছাড়া সম্প্রতি যারা হাতির আক্রমণে মারা গেছেন। তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা জুলাই মাসে আসতে পারে।
বিএনএনিউজ/হামিমুর রহমান/এইচ.এম।