বিএনএ ডেস্ক : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সোমবার বিকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর এলাকা থেকে সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে চট্টগ্রামে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদোহী মামলায় গ্রেপ্তার করে। মঙ্গলবার দুপুরে তাকে চট্টগ্রামের আদালতে নেয়া হয়। সকাল থেকেই তার ভক্ত অনুসারিরা আদালত এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে মুক্তির দাবি জানায়।
মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তার জামিন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে হাজার হাজার চিন্ময় অনুসারি। তারা প্রিজন ভ্যানের চারিদিকে ঘিরে রাখে। অনেকে ভ্যানের সামনে শুয়ে পড়ে, কারাগারে নিতে বাধা দেয়। এই অবস্থায় পুলিশ প্রিজন ভ্যানে থাকা চিন্ময় দাস প্রভুর সহযোগীতা চায়। তাকে দেয়া হয় হ্যান্ডমাইক। এ সময় চিন্ময় বলেন “রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নষ্ট হয় আমরা এইরকম কিছু করবো না। আবেগকে সংযত করে, আবেগকে শক্তিতে পরিণত করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবেন”।
কিন্তু তার সনাতনী ভক্তরা অবরোধ প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। এই অবস্থায় আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনী, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে চিন্ময় ভক্তরা ব্যাপক ভাংচুর চালায়। চট্টগ্রাম আদালতের পরীর পাহাড় থেকে শুরু করে, পুরাতন বাংলাদেশ ব্যাংক, রঙ্গম সিনেমা, কোতোয়ালী মোড়, লালদিঘী, হাজারিগলি, বক্সি পুলিশ বিট, আন্দরকিল্লা এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, সনাতনী হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে ত্রিমূখী সংর্ঘষ কালে সাইফুল ইসলাম নামে একজন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটরের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে অন্তত ২০ জন। যাদের মধ্যে অন্তত সাতজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে সনাতনী জাগরণ জোটের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে চট্টগ্রামের সহিংস ঘটনাকে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি বিনষ্ট করার পায়তারা উল্লেখ করে বলা হয়, চিন্ময় দাসকে জামিন দেয়া না হলে লং মার্চ ও স্বেছায় কারাবরণ কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ অক্টোবর বিএনপি নেতা ফিরোজ খান চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ ১৯জনকে আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে একটি মামলা করে। এই মামলা দায়ের করার পর ফিরোজ খানকে দল থেকে বহিস্কার করে বিএনপি।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে লালদীঘির মাঠে একটি মহাসমাবেশ হয়। এই দিন নিউমার্কেট গোল চত্বরে জাতীয় পতাকার উপর সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় গোষ্ঠী ইসকনের গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করে সেখানে স্থাপন করে দেয়। যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অখন্ডতাকে অস্বীকারের শামিল।
এদিকে, এ গ্রেপ্তার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
তিনি বলেছেন, “কেউ যদি রাষ্ট্রদ্রোহের মতো ঘটনায় যুক্ত থাকে, সে যেই হোক, যত বড় নেতাই হোক, তাকে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবে না।”
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যা ও ইসকনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, ইসলামী ছাত্র সেনা, হেফাজতে ইসলামীসহ বিভিন্ন সংগঠন সারাদেশে সমাবেশ ও মিছিল করেছে।
এ দিকে ইসকন নিষিদ্ধ চেয়ে এবং যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে চট্টগ্রাম ও রংপুরে জরুরি অবস্থা জারির নির্দেশনা চেয়ে বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চে আবেদন করেন এক আইনজীবী। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যার্টনি জেনারেলকে ডেকে পাঠান আদালত।
অ্যার্টনি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, যে কেউ কোনো অ্যাঙ্গেল থেকে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সরকার জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। সাম্প্রতিক ইস্যুতে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এসময় উচ্চ আদালত বলেন, তারা উদ্বিগ্ন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেউ যাতে অবনতি করতে না পারে। ইসকন ও সাম্প্রতিক ইস্যুত সরকারের পদক্ষেপ বৃহস্পতিবারের মধ্যে জানাতে বলেছেন হাইকোর্ট।
চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামের জানাজা শেষে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।
চিন্ময় দাস ইস্যুতে মঙ্গলবার বাংলাদেশকে বার্তা দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, “চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার এবং জামিন না পাওয়ার ঘটনা, আমরা যথেষ্ট উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি। ইনি বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতন জাগরণ মঞ্চের প্রধান মুখ। এর আগে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতন, অত্যাচার, খুন এবং ঘরবাড়ি লুট করার ঘটনা ঘটেছে। এর পর এই গ্রেপ্তারি ও জামিন না পাওয়া এটাই স্পষ্ট করে, বাংলাদেশ মৌলবাদীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে এবং লাগাতার সেখানে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ চলছে।
আমরা বাংলাদেশ প্রশাসনের কাছে আর্জি জানাচ্ছি বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দু ও অন্যান্য সকল বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। শুধু তাই নয়, তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার সুনিশ্চিত করুক বাংলাদেশ প্রশাসন।”
এর আগে সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের খবরে, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলীয় নেতা ও বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার পরবর্তী সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাড়ে তিন মাস বয়সি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হয়েছে। একদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ ও তাদের সমমনা বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের ইসকন নিষিদ্ধ করার দাবি, অন্যদিকে সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের লং মার্চ কর্মসূচী, এবং ভারতের কড়া হুঁশিয়ারিতে প্রচন্ড চাপে রয়েছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর নানা ইস্যুতে বড়ো ধরনের চাপ আসতে পারে। অব্যাহত চাপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার জার্নি শেষ করতে পারবে কীনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সৈয়দ সাকিব