এসেছিলাম মেট, বাবুর্চি, ফালতু, সিপাহিরা যারা আমার ঘরে থাকে তারা আমার কাছে এসে বলতে লাগল, ‘ভাববেন না স্যার। আল্লা করলে আপনার মা ভাল হয়ে যাবেন।
তাই ভাবি রাজনীতি মানুষকে কত নিষ্ঠুর করে। কয়েদিদেরও মায়া আছে, প্রাণ আছে, কিন্তু স্বার্থান্বেষীদের নাই । ভাবলাম রাতটা কাটাতেই কষ্ট হবে । কিন্তু কেটে গেল। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ বাইরে তাকাইয়া ছিলাম। দেখতে চেষ্টা করলাম ‘অন্ধকারের রূপ’, দেখতে পারলাম না। কারণ আমি শরৎচন্দ্র নই । আর তাঁর মতো দেখবার ক্ষমতা এবং চিন্তাশক্তিও আমার নাই ।
১১ই জুন ১৯৬৬ ॥ শনিবার
জেলার সাহেবকে খবর দিলাম, আমি দেখা করতে চাই । তিনি খবর পাঠালেন নিজেই আসবেন দেখা করতে। তিনিও শুনেছেন মায়ের অবস্থা ভাল না। বাইরে বসে দেখতে লাগলাম, একটা মোরগ একটা মুরগি আর একটা বাচ্চা মুরগি আপন মনে ঘুরে ঘুরে পোকা খেতেছে । আমার বাবুর্চি খাবার থেকে কোনোমতে কিছু কিছু বাঁচাইয়া এই কয়টা মুরগি জোগাড় করেছে। ছোট ছোট যে মাঠগুলি পড়েছিল আমার ওয়ার্ডে সেগুলিতে দুর্বা ঘাস লাগাইয়া দিয়াছিলাম । এখন সমস্ত মাঠটি সবুজ হয়ে উঠেছে । বৃষ্টি পেয়ে তাড়াতাড়ি বেড়ে চলেছে । দেখতে বড় সুন্দর হয়েছে জায়গাটি। এরই মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় মুরগিগুলি। অনেকক্ষণ বসে রইলাম। ফুলের গাছ চারদিকে লাগাইয়াছিলাম, নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করেছে। বড় চমৎকার লাগছে। আজকে সূর্যের জোর নাই, বেশ মেঘলা দিন। খুবই বাতাস বইছে। ঘরে ফিরে এসে বসলাম । দেখি কম্পাউন্ডার সাহেব আসছেন। বহুদিন দেখা হয় নাই। সিভিল সার্জন সাহেব জেল ভিজিট করেন সপ্তাহে দুইবার । কিন্তু দুই সপ্তাহ আমাকে দেখতে আসেন নাই। বোধ হয় আজ আসবেন। আধা ঘণ্টা পরে জেলের ডাক্তার সাহেবদের সাথে নিয়ে আমাকে দেখতে আসলেন। চিন্তা করে শরীর খারাপ করতে নিষেধ করলেন। খোদার রহমতে মা ভাল হয়ে যাবেন তাহাও বললেন। খুব খোদাভক্ত লোক এই বয়সে হজ্ব করেও এসেছেন। দেরি করতে পারেন না, অনেক কাজ। কাজ নাই শুধু আমাদের মতো বিনা বিচারে বন্দি হতভাগাদের!
আমি আবার বই নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাজতো একটাই। আমি তো একা থাকি । আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। একাই থাকতে হবে । জেলার সাহেব সিকিউরিটি ব্রাঞ্চের ডিপুটি জেলার সাহেবকে নিয়ে আসলেন। বসতে দিয়ে বললাম, ‘আপনার অনেক কাজ, বহু লোককে রাস্তা থেকে ধরে এনে জেল দিয়েছে—তাদের বন্দোবস্ত করা, তবু কষ্ট দিতে বাধ্য হলাম। বললাম, ‘আমাকে কেন একলা রাখা হয়েছে? আমার সহকর্মীদের কেন কনডেম সেলের মধ্যে রেখেছেন? তাদের মাত্র দেড়টাকা দেওয়া হয়েছে খাবার জন্য । অন্যান্য ডিপিআর ও রাজবন্দিদের এক জায়গায় রাখতে পারেন । তারা দেখাশোনা করে নিজের পাকের বন্দোবস্ত করতে পারে। ২৬ সেলে পুরানা সিকিউরিটি আছে। তারা এক জায়গায় আছে, তাদের পাকের বন্দোবস্ত তারাই করে। তাদের সামনেই পাক হয় । ডিপিআরদের এক এবং দুই নং ওয়ার্ডে রেখেছেন । তারা এক সাথে তাদের পাকের বন্দোবস্ত করে থাকে এবং তাদের সামনেই পাক হয় ডিভিশন পাওয়া কয়েদিরা এক জায়গায় থাকে, তাদেরও আলাদা পাক হয় ।
সূত্র: কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৮০-৮১, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী