।।ইয়াসীন হীরা।।
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তখন অনেকেই সন্দেহ করেছিল যে দেশটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকতে কী পারবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, কুটনৈতিক হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে কটাক্ষ করে কুটনৈতিক ভাষায় বলেছিলেন, বাস্কেট কেইস’! যা তলাবিহিীন ঝুড়ি বুঝায়।
৫০ বছর পরে, সেই সন্দেহগুলি স্থির হয়ে গেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, রাজনৈতিক অশান্তি, দুর্নীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দারিদ্র্যের মতো বেশ কিছু কণ্টকাকীর্ণ সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও, জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং শিশু মৃত্যু হ্রাসে আমরা যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছি এবং অন্যান্য অনেক আর্থ-সামাজিক খাতে ভালো পারফর্ম করছি। দেশ তার প্রথম দিন থেকে অনেক দূর এগিয়েছে এবং এখন কিছু বৃত্তে “উন্নয়নের রোল মডেল” হিসাবে ট্যাগ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাংলাদেশ কিভাবে “বাস্কেট কেস” থেকে “উন্নয়ন সারপ্রাইজ” এর দিকে এগিয়ে গেল? প্রতিটি সাফল্যের পেছনে একটা গল্প থাকে। তাহলে, বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক রূপান্তরের পেছনের মানুষটা কে? এক কথায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দুই দফায় প্রায় ১৮ বছরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বাংলাদশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেন। গোটা বিশ্বকেই অবাক করে দিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। উন্নত বিশ্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের এ অর্জনে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট উচ্চবিলাসী কতিপয় বিপদগামী সেনা সদস্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার দিন শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা ছিলেন জার্মানীর ব্রাসেলস শহরে স্বামী ড. ওয়াজেদের বাসায় । এরপর সেখানকার রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সহযোগিতায় অতি গোপনীয়তায় ভারতে আশ্রয় নেন এবং ৬ বছর আত্মগোপন জীবনযাপন করেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্য বিভাজন তৈরী হলে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। পরেরদিন সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।তখন থেকে শুরু হয়, আরেক সংগ্রামী জীবন।
শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যা চেষ্টা
৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ দলের সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার পর বহু প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী লীগের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাও খুশি ছিলেন না। তারা কম বয়সী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। গণমানুষের ভাগ্য উন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক মিশন শুরু করেন। বাড়তে থাকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত, বিএনপি চক্র বঙ্গবন্ধু কন্যার জনপ্রিয়তা মেনে নিতে পারেনি। তাকে হত্যা করার জন্য গোপনে ও প্রকাশ্যে ১৯ বার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ অসীম রহমতে তিনি প্রত্যেক বার নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ও ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট হত্যা প্রচেষ্ঠা ছিল ওপেনসিক্রেট।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ও ২১ আগষ্ট ২০০৪
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি এরশাদ সরকার চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে জনসভাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্ঠা হয়। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সে সময় মানব ঢাল তৈরি করে তাকে রক্ষা করেন। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ২৪ জন। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গ্রেনেড হামলা করে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। এতে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভি রহমানসহ ১৯ নেতাকর্মী নিহত হন। পুঙ্গ হয় অসংখ্য। দলের ভেতরে-বাইরে সব ষড়যন্ত্র, প্রতিবন্ধকতা দৃঢ়তার সঙ্গে সম্মোহনী নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক নানা কুটকৌশল ও ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হতে পারেনি।
আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিন আজ
১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। মূলত এর পরই শুরু হয় শেখ হাসিনার লক্ষ্য পূরণের এক অবিশ্বাস্য যাত্রা। তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে দৃঢ প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যান শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার অর্জন:
৩০ লক্ষ শহীদ ও তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া এই বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাজরো বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেবার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো,শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক এবং পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ।
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অর্জন হলো মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এবং ইনডেমেনিটি বিল বাতিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিস্পত্তি। ভারতের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যার সমাধান। ২০১৬ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় করা হয় শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায়।ছিটমহল বিনিময়ের ফলে ভারত ও বাংলাদেশের মানচিত্র পরিবর্তন করতে হয়েছে। এতগুলো ছিটমহল বিনিময়ের এমন নজির বিশ্বে নেই।
শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ :
বঙ্গবন্ধু কন্যা ও চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। তিনি এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৩০টি পুরস্কার ও পদক অর্জন করেছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘের ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ লাভ করেন। নারী-পুরুষ বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের জন্য একই বছর শেখ হাসিনা ওম্যান ইন পার্লামেন্ট (ডাব্লিউআইপি) গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। নারী ও শিশু শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ‘শান্তিবৃক্ষ পদক’ পুরস্কারে ভূষিত করে ইউনেসকো। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন পদক পান শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর চৌকষ নেতৃত্ব
দারিদ্র্য দূরীকরণ, পৃথিবীর সুরক্ষা ও সবার জন্যে শান্তি-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন)’এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়েছে এ বছর (২০২১)।
বিশ্বের নিকট পথিকৃৎ বাংলাদেশ:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতায় রুপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন এটি একটি বড় অর্জন। এটি সম্ভব হয়েছে তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উঠে আসে জন্মের ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে জাতির পিতা কীভাবে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে কীভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হতে যাচ্ছে।
শিক্ষায় দেশের অগ্রগতি:
শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো- শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭ ভাগে। শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে “শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে, গঠন করা হয়েছে “শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট” গঠন।
নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেবার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি ব্যবস্থা। বর্তমান ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য:
শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে “জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা ২০১১”।স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ১২টি মেডিকেল কলেজ, নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৪৭ হাজারেও বেশি জনশক্তি।
তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২টি উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপতালগুলোতে ২ হাজার শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯০ সালে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৪৯ থেকে নেমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫৩তে ।
নারীর ক্ষমতায়ন:
বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেকদূর এগিয়েছে। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে গৃহীত হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে “জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১”। “জাতীয় শিশু নীতি-২০১১” প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দেশের ৪০টি জেলার সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল। দুঃস্থ, এতিম, অসহায় পথ-শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র।
পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। আর এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী। ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নে ও নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। আর ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ৮০% এর ওপর নারী। বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে।
তথ্য প্রযুক্তি জগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মতো ইউনিয়ন ভিত্তিক কার্যক্রম। তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও।
উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশ :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় ক্ষমতায় আসার পর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। সেটি এখন দৃশ্যমান। ক্ষমতাসীন হওয়ার ধারাবাহিকতায় তিনি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌছে দেয়ার রূপকল্প গ্রহণ করেছেন। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেবার অভিপ্রায়ে দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫০০০। দেশের সবক’টি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়।
টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লক্ষ এবং ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৬ লক্ষে উন্নীত হয়েছে। সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে চালু করা হয়েছে ই-পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং। সরকারী ক্রয় প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পাদন করার বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। ৪-জি প্রযুক্তির মোবাইল নেটওয়ার্কের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে।আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ৫জি যুগে প্রবেশ করবে। এ জন্য সার্বিক প্রস্তুতি প্রায় শেষ।
খাদ্য নিরাপত্তা:
প্রায় ২০ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য এখন রপ্তানিও করছে বাংলাদেশ। খাদ্যের অভাবে বা না খেয়ে মৃত্যুবরণের সংখ্য শুণের কোঠায়। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যেই জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে সরকার। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ভেজাল খাদ্য পরিবেশন প্রতিরোধে হোটেল রেস্টুরেন্টগুলো গ্রেডিংয়ের আওতায় আনা হচ্ছে।
ভূমিতে আমূল পরিবর্তন:
বাংলাদেশে কিছুদিন আগেও ভূমি ব্যবস্থাপনায় ছিল হ-য-ব-ল। কিন্তু এখন ভুমি ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন হয়েছে। এখন কোন জমি একাদিকবার দলিল করার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ভূমি
ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন ক রা হয়েছে। সবগুলো জেলায় মৌজা ম্যাপ ও খতিয়ান কম্পিউটারাইজেশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভূমির পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রণীত হয়েছে “কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ২০১২।
শতভাগ বিদ্যুতায়তন :
বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে। জাতীয় গ্রিডে প্রতিবছর অতিরিক্ত বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে। কিছু কিছু জেলা এখন শতভাগ বিদ্যুায়িত হয়েছে। ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে সবার জন্য নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণকল্পে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যার সুফল মানুষ ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ২৪ হাজার ৯৮২ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে এবং বিদ্যুতের সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ ভাগে উন্নীত হয়েছে।
যার ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সাথে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ৩৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ৩৫ লক্ষ গ্রাহককে।নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ৬৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
শিল্প-বাণিজ্য:
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ঔষুধ, ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে জাহাজ, ঔষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী। বাংলাদেশের আইটি শিল্প বহির্বিশ্বে অভূতপূর্ব সুনাম কুড়িয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের ৪৫টি দেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে।
দেশের প্রধান রফতানিখাত তৈরি পোশাক। দেশের রফতানির প্রায় ৮১ ভাগ আসে এ খাত থেকে। দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে । ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে তৈরি পোশাক রফতানি করে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে এ খাতে ৪.১ মিলিয়ন শ্রমিক কাজ করছেন, এর অধিকাংশই নারী। দেশের জনশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী; এ বিপুল সংখ্যক নারী জনশক্তিকে উৎপাদনশীল খাতে অবদান রাখার সুযোগ করে দিয়েছে তৈরি পোশাকখাত।
শান্তি মিশন:
হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে ডিআর কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের সব সংঘাতপূর্ণ এলাকার জনমনে শ্রদ্ধার স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্বমানবতার সেবায়।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩৯টি দেশের ৬৪ শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ যাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে। শান্তি রক্ষা মিশনে অবদান রাখা দেশগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জাতিসংঘের ‘ডিপার্টমেন্ট অব পিসকিপিং অপারেশন্স’ প্রতিবেদন অনুসারে, সর্বোচ্চ সেনা প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সবার শীর্ষে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে রুয়ান্ডা দ্বিতীয়, ইথিওপিয়া তৃতীয়, নেপাল চতুর্থ, ভারত পঞ্চম এবং পাকিস্তান ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছে।
৪০টি দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা
আড়াই যুগের বেশি সময় ধরে বিশ্বের ৪০টি দেশের ৫৪টি মিশনে শান্তি রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রেখে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা দেশের গৌরব বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক অবদান রেখেছেন তাঁরা।
দেশের প্রায় দুই হাজার নারী শান্তিরক্ষী এরই মধ্যে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে সাফল্যের সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেছেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশি নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণও ক্রমে বাড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ২৭০ জন নারী জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই সর্বপ্রথম ২০১০ সালে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে পুলিশের নারী দল পাঠায়।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়
১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১৩৫.৬২ মার্কিন ডলার। ৫০ বছর পর মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২২ ২৭ ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। যে মানুষটি নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে তিনি আর কেউ নয়- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম সন্তান শেখ হাসিনা। তিনি দেশ বিদেশের সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। ২৮ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া শেখ হাসিনা ৭৫ বছরে পা দিয়েছেন। দীর্ঘজীবী হোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
লেখক: রাজনৈতিক গবেষক ও নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি
এসজিএন