গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় চরম নাটকীয় পরিস্থিতিতে দিল্লির কাছে হিন্দন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেছিলেন বাংলাদেশের সদ্য-সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যে বিমানে করে তিনি দিল্লিতে এসে নামেন, সেটিতে তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। সেই অবতরণের পর পুরো তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। কূটনৈতিক লাল পার্সপোট বাতিল হওয়ায় দেড় মাস পর তার অবস্থান কোথায়, কেমন, হবে তা দিল্লী এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানাচ্ছে না।
এছাড়া শেখ হাসিনা এখন কোথায় আছেন, কেমন পরিবেশে আছেন, ভারতেই তিনি আপাতত থেকে যাবেন, নাকি অন্য কোথাও যাবেন, তা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনার ডালপালা মেলছে। ছড়াচ্ছে নানা রকমের গুজব।
শেখ হাসিনা ৫ আগষ্ট ভারতে নামার পর প্রথম রাতটি ছিলেন দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটির ভিভিআইপি লাউঞ্জে। হিন্দন মূলত: একটি সামরিক বিমানঘাঁটি, তাই সেখানে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের থাকারও সুব্যবস্থা আছে। সেখানে প্রথম রাতটি কাটানোর পর তাকে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে গাজিয়াবাদে আধাসামরিক বাহিনীর একটি সেইফ হাউজে নেওয়া হয়। তবে তাকে ১০/১২ দিন আগে গভীর রাতের অন্ধকারে রাজধানী দিল্লিরই কোনও গোপন ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া হয় আকাশপথে, হেলিকপ্টারে চাপিয়ে।
শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে গত বছর থেকে মূলত দিল্লিতেই বসবাস করছেন। শেখ হাসিনা যখন ৫ই আগস্ট দিল্লিতে এসে নামেন, তিনি তখন ডব্লিউএইচও’র কাজে থাইল্যান্ডে ছিলেন, পরে অবশ্য দ্রুত দিল্লি ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে মা ও মেয়ের মধ্যে শহরে একাধিকবার ‘ইন-পার্সন’ দেখা হয়েছে। ভারত বিষয়টিকে একেবারেই প্রচারের আলোর বাহিরে রাখতে চাইছে।
শেখ হাসিনা যেরকম পরিস্থিতিতে ভারতে এসে পৌঁছেছেন সেরকম ক্ষেত্রে ‘অতিথি’কে ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ‘ডিব্রিফ’ করাটা রেওয়াজ। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
বেশিরভাগ সময় এই ডিব্রিফিং একটা সেশনে শেষ হয় না– পর পর বেশ কিছুদিন ধরে চালাতে হয়। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এর মধ্যেই বেশ কতগুলো ডিব্রিফিং সেশন হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ভারতে অবস্থানরত তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা যখন ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন– তখন তাকেও দীর্ঘ ডিব্রিফিং সেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তিন সপ্তাহ ধরে তাকে ‘ডিব্রিফ’ করে, তারপর তাকে দিল্লিতে এনে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করানো হয়।
শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে যেটা ব্যতিক্রম– তা হলো তার ‘ডিব্রিফিং সেশন’গুলো পরিচালনা করছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল নিজে। ভারত সরকারের ‘শীর্ষতম মহলে’র সঙ্গেও শেখ হাসিনার একাধিকবার যোগাযোগ হয়েছে।
দিল্লিতে শেখ হাসিনার অবস্থান দীর্ঘায়িত হতে পারে– সেই সম্ভাবনা যেমন জোরালো হচ্ছে, পাশাপাশি ভারতের তরফে তৃতীয় কোনও ‘বন্ধু’ দেশে তাকে পাঠানোর চেষ্টাও কিন্তু মোটেই থেমে নেই।
এখনও পর্যন্ত ভারত সরকারের ঘোষিত অবস্থান হলো, শেখ হাসিনা ভারতে এসেছেন ‘সাময়িকভাবে’। তবে তিনি কতদিন ভারতে থাকতে পারেন, সে ব্যাপারে ভারত সরকার এখন অবধি কিছুই বলেনি। পাশাপাশি তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হবে কিংবা হবে না, সে ব্যাপারেও মুখে কুলুপ এটেছে। দিল্লির তরফেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু হয়।
প্রথমে যে কয়েকটি দেশকে ‘প্রস্তাব’ করা হয়েছিল সেগুলো হলো- যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপের দু-একটি দেশ খুব সম্ভবত ফিনল্যান্ড, চেক ও স্লোভেনিয়া। তবে শেখ হাসিনা এর কোনও দেশেই আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেননি, পুরো আলোচনাই চালানো হয়েছিল ভারতের পক্ষ থেকে।
এরপর আরেকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল, যারা ঠিক ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত নয়। এই দেশটি হলো মধ্যপ্রাচ্যের খুব প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শক্তি– কাতার।
শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে কাতারের সঙ্গে ভারতের অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এখনও কোনও ‘ব্রেকথ্রু’ হয়নি ঠিকই, আবার সেই কথাবার্তা পুরোপুরি ভেস্তেও যায়নি। এই জটিল আলোচনা এখনও চলমান।
তবে শেষ পর্যন্ত কোনও উপযুক্ত তৃতীয় দেশে শেখ হাসিনাকে পাঠানোর চেষ্টা যদি সফল না-হয়, সেই ক্ষেত্রে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে ভারতেই রেখে দেওয়ার জন্য দিল্লি মানসিকভাবেও প্রস্তুত রয়েছে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সোমবার রাতে নিজের ’এক্স হ্যান্ডল’ এ বাইডেনের সঙ্গে আলাপের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মোদি। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি এবং দেশটিতে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছি। পাশাপাশি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু—বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই ফোন আলাপ বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা দেখতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে ।
বিএনএনিউজ /
শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ হাসনা
/এইচমুন্নী