বিএনএ, চট্টগ্রাম: বিউটি আক্তার (৩৫)। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার আহসানিয়া পাড়া এলাকায় বসবাস করেন। পেশায় একজন সরকারি চাকুরিজীবী। সামাজিক নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষায় তরুণীর অনুরোধে ভুক্তভোগীর নামটি এখানে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
গত বছরের ৮ নভেম্বর তার ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বরে ০১৯৬৪-৩৫৮৩১৮ এই নস্বর থেকে একটি ক্ষুদে বার্তা আসে। ওই ক্ষুদেবার্তাটি বাংলা করলে দাঁড়ায়-‘প্রিয়’ আপনি ইন্টারভিউ পাস করেছেন। এখানে যান ২০০০ টাকা দিনে বেতন পাবেন। সাথে হোয়াটসঅ্যাপ লিঙ্ক যুক্ত হোন।’
লিঙ্কের হোয়াটসঅ্যাপটি খোলা হয়েছে এই ০১৭৮৯-৭৮১৮২৮ নম্বর দিয়ে। লিঙ্কে প্রবেশ করে দেখেন তিনটি ভিডিও লিঙ্ক শেয়ার করার কথা জানানো হয়। যে তিনটি লিঙ্ক শেয়ার ও লাইকে ৫০ টাকা করে মোট ১৫০ টাকা পাবেন বিউটি আক্তার। তাদের কথামতো কাজটি করলে তরুণীকে সাথে সাথে ০১৮৬১-০৩০৭৬২ এই নম্বর থেকে তাৎক্ষণিক প্রতারকেরা ১৫০ টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দেন।
ঘটনার সময়টি ছিলো গত বছরের ৯ নভেম্বর বিকাল ৪টা ৫ মিনিট। একই দিন বিকেল ৫ টা ৪৬ মিনিটে তাদের কথামতো কাজ করলে আবারো ০১৮৩৯-৮৫৯৪৯৮ এই নম্বর থেকে পাঠানো হয় ১৪০০ টাকা। এটাই ছিলো প্রতারণার প্রথম দরজা।
পরে আরেকটি টেলিগ্রাম লিঙ্কে নিয়ে যান। টেলিগ্রাম আইডির নামটি ছিলো লউরেন্স গোমেজ। ওই আইডি থেকে আবার তরুণীকে লিঙ্ক করে দিলেন মিগেল এঞ্জেল নামে আরেকজনের সাথে। তাদেরও একই অফার লিঙ্ক শেয়ার করতে হবে তরুণীকে।
টেলিগ্রামের এই চ্যানেলে লাইক ফলোয়ার ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন। ওই গ্রুপেই যুক্ত করে নেন তরুণীকে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেই তরুণীকে এক টেলিগ্রাম চ্যানেল থেকে অন্য টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত করেন। যেখানে আগে থেকেই তিন-চারজন সদস্য ছিলেন। তারা গ্রুপে টাকা লেনদেনের বিভিন্ন স্ক্রিনশট শেয়ার করেন। এমনকি ইসলামী ব্যাংক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের একাধিক একাউন্টের স্ক্রিন শট তারা আপলোড দেন। তারা এটাই বুঝিয়েছিলেন সকলে টাকা পাচ্ছেন।
এরপর তাকে বলা হয়, অ্যাডভান্স বেনিফিট ট্যাক্সে ১৬০০ টাকা ইনভেস্ট করলে ২৪০০ টাকা পাবে। এক গুণ টাকা ইনভেস্ট করলে দ্বিগুণ টাকা মিলবে বলে আশ্বাস দেয়। এ শর্তে ভুক্তভোগী তরুণী রাজি হলে তাকে ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্টের লিংক দেন। সেখানে একটি একাউন্ট করে একটি বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠাতে বলেন। একের পর এক নম্বর। একের পর এক লেনদেন। পরে তরুণী তার একাউন্টে জমানো টাকা তুলতে গিয়ে দেখেন একাউন্ট লক।
পরে সমস্যা সমাধানের জন্য আবারো ইনভেস্ট করতে বলেন। তবুও সমস্যা সমাধান না হওয়ায় তার সন্দেহ হয়। উল্টো পেমেন্টের ভুয়া স্কিনশট দিতে থাকেন। এভাবে একাধিক দফায় ১২৩ টি বিকাশ নম্বর ও ২টি নগদ নম্বরে সুকৌশলে প্রতারক চক্রটি ২৭ লাখ ৯৩ হাজার ১৭৫ টাকা হাতিয়ে নেন। এরমধ্যে তরুণীর ধারদেনা করা ২৫ লাখ ও নিজের চাকরির বেতনের ২ লাখ ৯৩ হাজার ১৭৫ টাকা হাত ছাড়া হয়ে যায়।এতে প্রতারক চক্র ১২৩ টি বিকাশ নম্বর ও ২টি নগদ নম্বর ব্যবহার করে।
প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে তরুণী কোন উপায়ন্তর না দেখে প্রথমে বাকলিয়া থানা ও পরে সিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে ধর্না দিয়েও হতাশ হন।
পরে এ ঘটনায় ২৫ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) দুপুরে চট্টগ্রাম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসাইন মুহাম্মদ জুনায়েদের আদালতে ভুক্তভোগী তরুণী ওই প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।
বিজ্ঞ আদালত মামলাটি গ্রহণ করে সিআইডিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।
মামলায় আসামি করা হয়-এলাইসা, লউরেন্স গোমেজ, আন্টোনিও মালদোনাদো ইভানজেলিস্ট, রিতা মেরিন, এসোক হুর, মৌসুমী সম ও আত্রেয়ী রায়। এরা সকলে ছদ্মনামে দেশী-বিদেশী চক্র ও টেলিগ্রাম হোয়াটসঅ্যাপে উল্লেখিত নামধারী প্রতারক চক্রের সদস্য।
এ প্রসঙ্গে বাদি পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ বলেন, দেশি-বিদেশি এ ধরনের সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র শুধু এই নারী নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই এভাবে প্রতারণার জাল বিছিয়ে নিরীহ মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। প্রতারক চক্রের সদস্যদেরকে আইনের আওতায় আনতে না পারলে ভুক্তভোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলবে। এটাই আদালত কে বুঝিয়েছি।’
ভুক্তভোগী তরুণী বিউটি আক্তার বলেন, ‘বর্তমানে আমি খুব শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছি। মানসিকভাবেও খুব হতাশ। আমি প্রতারকদের ১২৩ টি বিকাশ ও ২ টি নগদ নম্বরে সমস্ত টাকা পাঠিয়েছি। কোন কোন নম্বর থেকে টাকা পাঠানো হয়েছে তাও জানিয়েছি। আমি আদালতের কাছে প্রার্থনা করেছি, ওই সমস্ত নম্বরের লেনদেন স্থগিত করে আইনি প্রক্রিয়ায় যেন আমার টাকা ফেরত পাই।’
বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/এইচমুন্নী