।। মোছাদ্দেক মওলা ।।
বিএনএ, ঢাবি: বছর ঘুরে আবারও এল মাহে রমজান। রাতে সাহরি করে সারাদিন রোজা রেখে ভালোমন্দ ইফতারি করেন সকলেই। সকলেরই চেষ্টা থাকে একটু ভালো কিছু খাওয়ার। কিন্তু আদৌ কি সেই ভালো খাওয়ার সুযোগ সবার হচ্ছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে বিভিন্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করেন। যাদের পরিবার মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের, এই রমজানের দোহাই দিয়ে লাথি পড়েছে বলছেন শিক্ষার্থীরা।
রমজান কেবলই শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে নানা অজুহাত ও কারণ দেখিয়ে প্রায় দেড়গুণ থেকে দুইগুণ খাবারের দাম বাড়িয়েছে ঢাবির আবাসিক হলের ক্যান্টিনগুলো। ফলে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ ক্যান্টিনে রমজানের অজুহাত দিয়ে অতিরিক্ত মূল্য নেওয়া হচ্ছে। তবে খাবারের দাম বাড়লেও বাড়েনি পরিমাণ ও গুণগত মান।
হলগুলোতে নিয়মিত যে খাবারের আইটেম রাখা হতো সেগুলো পরিবর্তন করে নতুন আইটেম যুক্ত করা হয়েছে এবং সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে চড়া দামে। এ নিয়ে কাহিল হয়ে আছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থী। ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষগুলোও রমজানের কারণে বাজারমূল্য বেশি বলে এমনটা করেছে বলে জানায়। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে এমন কিছু হতে দেয়া যাবে না। এর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রমজানের এক মাস ঢাবির হল ক্যান্টিনগুলো তিনবেলা খাবারের পরিবর্তে শুধু সাহরির সময় খাবার বিক্রি করে। শিক্ষার্থীরা জানায়, তিনবেলার টাকা একবেলায় তোলার জন্য এভাবে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ক্যান্টিন মালিকেরা।
বিভিন্ন হলের একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, খাবারের নাম ও আইটেম পরিবর্তন করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় দেড়গুণ থেকে দ্বিগুণ। ফলে নিজেদের খরচ সামলাতে পারছেন না সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বিভিন্ন হল ঘুরে দেখা যায়, ৪০-৪৫ টাকার খাবার একলাফে হয়েছে ৬৫-৭০ টাকা। আবার খাসি, চিংড়ি এসব আইটেম এনে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০-৮০ টাকা। সাথে অতিরিক্ত সবজি নিলে দাম দাঁড়ায় ১০০ টাকার কোটায়। অথচ দুইদিন আগেও ৫০ টাকার ভেতর ভরপেট একবেলা খাবার খেতে পারতেন ঢাবি হলের শিক্ষার্থীরা।
সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান মিজান বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সিকে (বিএনএ) বলেন, আগে আমরা ৪৫-৫০ টাকায় ভরপেট খেতাম। এখন দেখি সব খাবারের দাম ৮০ টাকা। ক্যান্টিন মালিককে জিজ্ঞেস করলে বলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি বলে এটি বাড়ানো হয়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এগুলো সব সিন্ডিকেট। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
স্যার এ এফ রহমান হলের আরেক শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, ‘রমজানে ক্লাসের কারণে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়। ঘরে থাকলে আম্মু প্রতিদিন ভালোমন্দ কিছু রান্না করে খাওয়াতেন। কিন্তু এখানে ভালো খাবারের নাম করে বাড়ানো হয়েছে দাম। যেটি মোটেও মুখরোচক নয়। হঠাৎ করে এই অতিরিক্ত দামে খাবার খেতে গিয়ে হিসেব মিলাতে পারছি না আমরা। পড়াশোনার কারণে নিজের কপালকে কুরবানি দিচ্ছি। এই রমজানের দোহাই গিয়ে আমাদের পেটে লাথি মারছে ক্যান্টিনগুলো।
তবে বিভিন্ন হল ঘুরে দেখা যায়, মেসের খাবার একই দামে তুলনামূলকভাবে ভালো। মেসে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করতে হয় বলে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা মেসে কার্ড করতে পারে না। ফলে একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ক্যান্টিনের দিকেই যেতে হচ্ছে। যেটি সবার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান তারা।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ব্যতীত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের হল—জগন্নাথ হলে দামের কোনো হেরফের হয়নি। তবে তারা কোন বাজার থেকে জিনিসপত্র কেনেন এমন প্রশ্ন তুলেন একাধিক শিক্ষার্থী! জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী অনিরুদ্ধ সাহা ফেসবুকে জগন্নাথ হলের ক্যান্টিনের মূল্য তালিকার একটি ছবি দেন। যেখানে দেখা যায় খাবারের দাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলগুলোর তুলনায় অর্ধেক বা তারও বেশি কম। এই উদাহরণ দিয়ে তিনি লেখেন, জগন্নাথ হল যদি পারে তাহলে অন্যান্য হলগুলো কেন পারে না? এখানে খাবারের মেন্যু আর দাম দুইটাই মোটামুটি চলনসই। যারা রোজায় সিন্ডিকেট করে খাবারের দাম বাড়ায় তারাও ধর্মব্যবসায়ী।
ক্যান্টিনের খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হলের ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয় বিএনএ-এর। তারা প্রত্যেকেই বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কথা বলেন। স্যার এ এফ রহমান হলের ক্যান্টিন মালিক বাবুল মিয়ে বলেন, শুধু আমাদের না, সব ক্যান্টিনেই খাবারের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। তাই আমাদেরও বাড়াতে হয়েছে। কয়েকদিন পর বাজারের জিনিসের দাম কমলে আমরাও কমিয়ে দেবো।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হলের ক্যান্টিন মালিক ডালিম বলেন, আমরা এখন একবেলা খাবার বেচি। তাছাড়া বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি। কেনা বেশি পড়ে বলেই বেশিতে বেচতে হচ্ছে। কী করব ভাই বলেন। এভাবে জসীম উদ্দীন হল, স্যার এ এফ রহমান হলের ক্যান্টিন মালিকেরাও বাজারদরের ওপর দোষ চাপান।
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকদফা তাদের সাথে বসেছেন বলে জানিয়েছেন সূর্যসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মকবুল হোসেন ভুঁইয়া। তিনি বলেন, আমি ছাত্রদের সাথে কয়েক দফায় মিটিং করেছি। এভাবে অযাচিতভাবে দাম বাড়ানো যাবে না। বিষয়টা আমরা নজরদারিতে রাখছি। খাবার মান ও দাম দুটোই ঠিক রাখতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড.মো. আখতারুজ্জামান বলেন, অবিবেচকের মতো খাবারের দাম বাড়ানো যাবে না। যৌক্তিক কোনো কারণ আছে কি না সেগুলো হল প্রশাসন খতিয়ে দেখে তথ্য দেবে। এর ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বিএনএ/এমএফ