বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র একটি প্রামাণিক গ্রন্থ যা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। ১৫ খন্ডে প্রকাশিত এ তথ্য ভান্ডারে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের অজানা। বিশেষ করে এ প্রজন্ম জানেই না কত রক্ত, কত কষ্ট, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্জন ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাঙ্গালি জাতি বিলীন হয়ে যেত! এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে। ১ মার্চ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীনতার নেপথ্যে গণ মাধ্যমের ভূমিকা, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
আজ(২৭ মার্চ২০২২) প্রকাশিত হলো
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৭
টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে বাংলাদেশে পাক-হানাদারদের হত্যা, নির্যাতন ও ব্যাভিচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের একটি সর্বহারা বালিকার এক মর্মান্তিক কাহিনী তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন : লালফুল ও সবুজ লতাপাতা আঁকা গোলাপি রঙের একটা ছেঁড়া ফ্রকের আট-ন’বছরের বালিকা ইসমত আরার মুখে আমি এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করেছি। আমি তাকে দেখলাম শরণার্থী শিবিরের অনতিদূরে একটি হাসপাতালে। শত শত আহতদের ভিড়ের একপ্রান্তে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। দিশেহারা দুটি ভীরু চোখ দিয়ে চারিদিকে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। সে যে আহত আমি তা দূর থেকেই লক্ষ্য করলাম। মনে হলো শীর্ণ আলোর একটি রেখার মত এই মেয়েটি তো কারও বিপদের কারণ হতে পারেনা। এই ছোট্ট মেয়েটি ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে কি এমন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো যার জন্যে তারা এভাবে আঘাত করেছে? একজন পাকিস্তানী সৈন্য বেয়োনেট দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে। তার শ্বাসনালী কেটে দিয়েছে। সে তার গলার ব্যাণ্ডেজের উপর একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি বলল : আমার নাম ইসমত আরা। আমার বাবার নাম মরহুম ইশাক আলী।
কুষ্টিয়ায় আমার বাবার দোকান ছিলো। দু’মাস আগে বাবা আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে কুষ্টিয়ায় গেছেন। কিন্ত তারপর থেকে তিনি আর ফিরে আসেন নি। যেদিন বাবা কুষ্টিয়ায় রওনা হয়েছিলেন সেই রাতে আমি ঘুমোবার আগে বাইরে কোলাহল আর ভারী ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখতে যাওয়ার আগেই দেখতে পেলাম অনেকগুলো পাক সৈন্য আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তারা আমাদের ঘরে ঢুকেই আমার দাদাকে গুলি করে। আমার দাদা বি.এস.সি পাস করেছিলো। তারপর তারা আমার মা ও বোনদের ওপর অত্যাচার চালায় এবং তাদের শেষ পর্যন্ত বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। একজন সৈন্য লাফ দিয়ে এসে আমাকে আঘাত করে। তারা বেয়োনেট দিয়ে আমার গলায় আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়ে যাই এবং মৃতের ভান করি। তারপর সৈন্যরা চলে গেলে পরেরদিন একজন লোক গিয়ে আমাকে অচেতন অবস্থায় তুলে নিয়ে আসে। এই কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন কেমন হয়ে পড়েছিলো। সেই বীভৎস দৃশ্য যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। সে তা সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ সরে গেল আমার কাছ থেকে। আর তাকে দেখতে পেলাম না। আমি তার ওয়ার্ডের ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করলাম।
ডাক্তার আমায় জানালেন, একদিন এক ভদ্রলোক তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসে। এরপর হাসপাতালে আহত শরণার্থীদের ভিড় ঠেলে আমি যখন বাইরে বের হচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় ইসমত আরা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার দু’চোখের কোণায় জল টলমল করছিলো। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নিয়ে সে আমায় জিজ্ঞেস করলো : বলুন না এখন আমি কি করবো? জানেন আমরা পাঁচ বোন ছিলাম, আমার ভাই ছিলো, আমার মা-বাবা ছিলো। কত সুন্দর আমাদের ঘরবাড়ি ছিলো। আজ আমার কেউ নেই, কিছু নেই। আমি আজ এতিম। বলুন না আমি কোথায় যাব? আমার কি হবে। আমি তাকে বললাম, আর তো কোন ভয় নেই। তুমি এখানে চলে এসেছো, এখন তোমার ভয়ের কিছু নেই। কপট এক নির্বোধের মত তাকে আমি সান্ত্বনার কথাগুলো বললাম- কিন্ত ইসমত আরার কি হবে? কি হবে আরও হাজার হাজার ইসমত আরার?
টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, আমেরিকার নিউজার্সির কংগ্রেস সদস্য মি: কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার আমায় বলেছেন যে, পাক বাহিনীর বর্বরতার খবর অতিরিক্ত বলে আমি প্রথমে মনে করেছিলাম এবং প্রকৃত সত্য যাচাইয়ের জন্যেই আমি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম কিন্ত আমি যা দেখেছি তা অবর্ণনীয়। মি: গ্যালাঘার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর একজন বিখ্যাত সামরিক অফিসার ছিলেন। তিনি বলেছেন : দ্বিতীয় বিশ্ব সমরের সময় ফ্রান্সে বিধ্বস্ত এলাকাগুলো আমি দেখেছি- মর্মান্তিক বধ্যভূমিগুলোও আমি দেখেছি, কিন্ত আমি এমনটি কখনও দেখিনি। এ বীভৎসতা, এ বর্বরতার কোন তুলনা হয় না।
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – ৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ৬৪-৬৫) চলবে
পড়ুন আগের পর্ব সমূহ:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৪
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা