বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, কিছু মানুষ রাজকপাল বা ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। যাদের জীবনে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না; তাও তারা প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যান। এসব ব্যক্তি জীবনের সমস্ত বৈষয়িক সুবিধা ভোগ করেন। এই ধরনের ব্যক্তিকে জীবনে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না, তিনি সহজেই সব আরাম-আয়েশ উপভোগ করেন। এমনই একজন রাজকপাল নারীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তার নাম মুক্তা রাণী রায়। বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের চণ্ডিপুর গ্রামে।
তার স্বামী এক সময় কোর্টে মুহুরি হিসেবে কর্মরত ছিলেন । যা আয় হত তা দিয়ে সংসারে সবসময় ছিল টানাপোড়েন। তাদের সংসারে রয়েছে তূর্য ও মাধুর্য নামে দুই সন্তান। একদা স্বামী মারা যায়।
স্বামী মারা যাওয়ার পরে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েন মুক্তা রানি । দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার চাচাতো ভাই দুলালের মাধ্যমে ২০১০ সালে আয়া পদে চাকরি নেন সিভিল সার্জন অফিসে। সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনের সুপারিশে মুক্তা রানির চাকরিরত অবস্থায় সুন্দরী বিধবা মুক্তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে রমেশের । তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মুক্তা রাণীকে। চার বছর আয়া পদ থেকে চাকরি ছেড়ে যোগ দেন ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাসপাতালের কেনাকাটা, খাবার, আউটসোর্সিং-এ নিয়োগ বাণিজ্য করে আঙুল ফুলে যেন কলাগাছ হয়েছেন মুক্তা রানি। পোষাক ও চলন বলনে বেশ পরিবর্তন আসে। মুক্তা রায় রমেশ চন্দ্র সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচিতি পান। মুক্তা রাণী থেকে নাম পরিবর্তন করে হয়ে ওঠেন মুক্তা সেন। ধীরে ধীরে শুরু হয় মুক্তা সেনের উত্থান।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মুক্তা রায়ের ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, রেন্ট এ কারের শো-রুম, ঠাকুরগাঁও শহরে ইসলামবাগে দুই তলা বাড়ি, শান্তিনগরে দুই জায়গায় প্লট আকারে ৫ শতক করে জমি, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলএসডি গোডাউনের পাশে ১০ শতক জমি, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পাশে ত্রি পিএম নামে একটি রেস্টুরেন্ট, সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বাদুপাড়ায় বাড়ি-জমি ও সয়াবিন তেলের কারখানা, চন্ডিপুরে বাড়ি, মিল-চাতাল ও পুকুর এবং আবাদি জমি রয়েছে ২০ বিঘা। সদরের গড়েয়া বাসস্ট্যান্ডে ৮ শতক জমির ওপরে বাড়িও রয়েছে মুক্তার। এছাড়া তিনি নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখলসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি ও বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার হয়েছেন। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের নওগাঁর অটো রাইস মিল, কয়েক কোটি টাকায় কিনেছেন এই মুক্তা।
সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ সেনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কথিত স্ত্রী সুন্দরী মুক্তা এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে। তার খালাতো ভাই দুলালকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খালাতো বোনের ছেলে নিপুণকে হাসপাতালের ঠিকাদারি, বোনের মেয়ে মৌকে স্কুলের শিক্ষিকা, আরেক বোনের ছেলে জয়কে রাজস্ব ও আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি দিয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক আত্নীয়-স্বজনকে।
শুধু তাই নয়, ভাইদের রাজনীতিতে যুক্ত করে ঠিকাদারি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে ভাতিজা-ভাতিজিদের সরকারি চাকরিও নিয়ে দিয়েছেন তিনি। হত্যা মামলায় ভারতে পলাতক থাকা বড় ভাই নারায়ণ ঠাকুরকে এনে যুক্ত করান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। মন্ত্রীর প্রভাব আর রাজনৈতিক দাপটে তারা হয়ে ওঠেন আরও প্রতাপশালী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরে মুক্তার দুই ছেলে তূর্য ও মাধুর্য এন্টারপ্রাইজ নামে পূবালী ব্যাংক হিসাব নম্বরে লেনদেন হয়েছে ২০ কোটি ৩৮ লাখ ২০৯৯ টাকা। সাবেক মন্ত্রী ও এমপি রমেশ চন্দ্র সেন আটক হওয়ার পর দিন সব টাকা তুলে নেন তিনি। বর্তমানে তার ছেলে তূর্যের অ্যাকাউন্টে রয়েছে ৬ হাজার ৪১৭ টাকা। এছাড়া জনতা, অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকে তাদের হিসাব নম্বরে গত দুবছরে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
মুক্তা রাণী রায়ের খালাতো ভাই ফণি রায় জানান, সবাই আমাকে বলে মন্ত্রী নাকি আামার ভগ্নিপতি। আমি বলি, বিয়ে তো খেলাম না। মুক্তার পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতো। পরে নিজে বাড়ি কিনেছে। আমাদের অনেক আত্নীয়-স্বজনকে চাকরি নিয়ে দিয়েছে। এলাকায় কিছু জমিও কিনেছে।
আরেক বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা সবাই তাকে এমপির দ্বিতীয় বউ হিসেবে চিনতাম। এলাকায় জমি, তার ভাই ও বোনসহ আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন। তাদের বংশের সবার চাকরি হয়েছে। এলাকার স্কুলগুলোতে অনেককে চাকরি দিয়েছে। চাকরির বিনিময়ে টাকা নিয়েছে; আবার কারো কাছে জমিও নিয়েছে। পাশেই মিল-চাতাল পুকুর ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় কেনার জন্য ৩০ লাখ অগ্রীম টাকাও দিয়েছিল।
ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ বলেন, ২০১০ সালে মুক্তা রাণী আয়া পদে যোগদান করেন। পরে ২০১৪ সালে তিনি সেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন।
সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার কথিত স্ত্রী মুক্তা সেনও পালিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিএনএনিউজ, সৈয়দ সাকিব/এইচমুন্নী