।।মিজানুর রহমান মজুমদার।।
মুক্তিযুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী জেনারেল এ এ কে নিয়াজি তার ‘The Betrayal of East Pakistan’ বইয়ে ২৫শে মার্চের রাতের ঘটনা বিররণ দিয়েছেন এভাবে : ‘Peaceful night was turned into a time of wailing, crying and burning…The military action was a display of stark cruelty, more merciless than the massacres of Bukhara and Baghdad by Chengiz Khan and Halaku Khan, or at Jalianwalabagh by the British General Dyer.’
(শান্তিপূর্ণ রাত পরিণত হলো আর্তচিৎকার, করুণ ক্রন্দন এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের নির্মম কালে…এই সামরিক অভিযান নির্মমতা ও হৃদয়হীনতার নিরিখে চেঙ্গিস খান ও হালাকু খানের বোখারা ও বাগদাদের হত্যাকাণ্ড অথবা ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ার কর্তৃক জালিয়ানওয়ালাবাগের নরহত্যার চেয়েও ছিল আরো বেশি ভয়ংকর। আরো বেশি বিভীষিকাময়।)
এতে বুঝা যায়, নিরহ বাঙ্গালি জাতির প্রতি কতটা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে পাক হানাদার বাহিনী। সেই কালরাতে শুধু ঢাকা নগরীতেই প্রায় ৫০ হাজার নর-নারীর প্রাণহানি ঘটে। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেনি রাতের অন্ধকারে ঘুমে অচেতন মানুষের ওপর এমন বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ড চালাবেন!
২৫শে মার্চের এই রাতে এ জনপদের নিরস্ত্র ও নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ শতাব্দীর সবচেয়ে অসম যুদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই রাতের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি হন।
পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে ঢাকায় ২৫শে ও ২৬শে মার্চে যে হত্যাকাণ্ড শুরু হয় তা যেমন ছিল নৃশংস, তেমনি ছিল কাপুরুষোচিত। কোনো কিছু বোঝার আগেই। কোনোরূপ সাবধানতা অবলম্বনের আগেই। এই মৃত্যু যে কত করুণ, কত নির্মম, তা এ জনপদের মানুষই জেনেছেন। সেই মৃত্যু কিন্তু বৃথা যায়নি। শত্রুকবলিত বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা লড়ে গেছেন জীবন বাজি রেখে।
২৫শে মার্চের রাত থেকেই দখলদার বাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। পুলিশ বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনী, ইপিআরের সদস্যরা বীরদর্পে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতার কাতারে শামিল হয়ে হানাদার বাহিনীকে যথোপযুক্ত শিক্ষাদানে কৃতসংকল্প হন।
ইয়াহিয়া খানের ১ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার ফলে সবার অলক্ষ্যে ছয় দফা দাবি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক দফা দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি দিকনির্দেশনা ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি।’ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো, শত্রুর মেকাবেলা কর,’’। প্রকৃত অর্থে ১ মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের কার্যক্রম বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে চলতে থাকে। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে উড়তে থাকে লাল সবুজের পতাকা।
৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে- আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দিবেন। তাদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন, তিনিই নেতৃত্ব দিবেন। যে কোনো মূল্যে আন্দোলন চালাইয়া যেতে হবে- অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষায়তন ছেড়ে, কৃষকদের একাংশ চাষাবাদ ছেড়ে, অনেক শ্রমিক মিল-ফ্যাক্টরি ছেড়ে, পেশাজীবীদের অনেকেই নিজ নিজ পেশা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হলেন। জনসাধারণের আত্মত্যাগের মহোৎসব, তা-ই মূর্ত হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে। যার ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙ্গালি জাতি মৃত্যুকে তুচ্ছ করেছেন সে বাঁশিওয়ালার হচ্ছেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঘটনাটি ১২৮৪ সালের শহরটার নাম হামেল্ন৷ সবাই চেনে হ্যামিলন নামে৷ ছোট্ট, সাজানো, সুন্দর শহর হ্যমিলন৷ এক সময় একজন লোক সেই শহরের বাঁশির সূরে ইদুর মুক্ত করেছিল। অনুরূপ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের মানুষ তৎকালীন বিশ্বের এক নম্বর সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।