বিএনএ, ঢাকা: শোষন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা বাঙালি ১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিলো ঢাকার রাজপথ। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্নিঝরা ভাষণের পর পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে আরও অগ্নিগর্ভ।
ওই সময়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুর যে নির্দেশ যেত বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ মেনে চলতেন অক্ষরে অক্ষরে। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা, স্কুল-কলেজ, গাড়ি, শিল্প-কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মূলত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে আক্রমণ চালায় ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে এবং পিলখানায় তৎকালীন সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ইপিআর-এর সদর দপ্তরে। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শুরু করে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচালিত বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার পর সেনাবাহিনীর একটি কমান্ডো দল ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে—২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টার পর—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর (পরে ব্রিগেডিয়ার) জেড এ খান।
আটক হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ২৬ মার্চের এক প্রতিবেদনে এ ঘোষণার উল্লেখ করা হয় এভাবে, ‘পাকিস্তানে আজ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান দেশের দুই অংশের পূর্বাঞ্চলকে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।’
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলি ছোড়া হয়, তখন রেডিও পাকিস্তানের একটি তরঙ্গে ক্ষীণভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ শোনা যায়। মনে হলো আগে রেকর্ড করা বাণী, যেখানে শেখ পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন।’
ওয়্যারলেসে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজ থেকেও শোনা যায়। এই দিনটিতে পূর্ব বাংলার ইতিহাস নতুন দিগন্তের দিকে মোড় নেয়। সূচনা ঘটে মুক্তিযুদ্ধের।
ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়: ‘…ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।…’
দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর খবর ছিল: ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২৭ মার্চের এক খবরে বলা হয়, ‘…২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তার এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।’
এর বাইরে ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর।
চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা: ২৬ মার্চ বেলা ২টা ১০ মিনিট এবং ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ পাঠ করা হয়। আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা শাখার নেতা এম এ হান্নান ‘বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচয়ে নিজ নামে এ ঘোষণা পাঠ করেন।
এরপর রাত ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন স্টেশন থেকে আবার বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথমে বাংলায় এবং পরে ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। ঘোষণাটি পাঠ করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচয়ে।
রাত ১০টায় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ইংরেজিতে একটি আবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার এবং মুক্তিকামী জনগণকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানানো হয়।
বিএনএ/এমএফ