28 C
আবহাওয়া
৯:০৫ পূর্বাহ্ণ - এপ্রিল ১৯, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » স্বাধীন বাংলা বেতার ও চরমপত্র

স্বাধীন বাংলা বেতার ও চরমপত্র

স্বাধীন বাংলা বেতার ও চরমপত্র

বিএনএ, জুয়েল বড়ুয়া: এ দেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যে যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ, উদ্দীপনা, অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে এবং হানাদার বাহিনীকে সার্বক্ষণিক রেখেছে ভীতসন্ত্রস্ত তা হল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আর এ মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের পরাজিত করার আনন্দ। যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রশস্ত্রে পিছিয়ে থাকলেও মনের জোরে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের মনের জোর আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি। বিদ্রূপ ও শ্লেষাত্মক অনুষ্ঠানটি রচনা ও উপস্থাপন করেছিলেন সাংবাদিক ও লেখক এম আর আখতার মুকুল। পরে অনুষ্ঠানটির প্রতিটি পর্ব গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় চরমপত্র নামেই।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক সরকারের দখলকৃত এলাকার ছয়টি বেতার কেন্দ্র থেকে অবিরাম মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জবাব দেয়া হয়েছে একমাত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের ওপর নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। খুনিদের হাত থেকে রক্ষার জন্য অসংখ্য মানুষ দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রথম থেকেই উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার।

এ বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা ও ইংরেজি খবর, সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’, ‘চরমপত্র’, ‘বিশেষ কথিকা’, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে বাণী’ বজ্রকণ্ঠ এবং দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান ‘জাগরণী’। তবে তারও আগের ইতিহাস হচ্ছে, চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে সংগঠিত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের দশজন নিবেদিত কর্মীস্থানীয় নেতা, জনগণের সহযোগিতায়।

এ বেতার কেন্দ্রের সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন সর্বজনাব বেলাল মোহাম্মদ, সৈয়দ আবদুস শাকের, আবদুল্লাহ আল ফারুক, মোস্তফা আনোয়ার, রাশেদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, শারফুজ্জামান ও কাজী হাবিবুদ্দিন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত শামসুল হুদা চৌধুরীর গ্রন্থে এসব তথ্যের উল্লেখ আছে। পরে এ বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে বিপ্লবী কথাটি বাদ দেয়া হয়েছিল।

এ বেতার কেন্দ্রের ওপর প্রচণ্ড বাধা এলো কয়েকদিনের দিনের মধ্যে। শত্রুর বোমারুবিমান থেকে ৩০ মার্চ ’৭১ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে বোমা ফেলা হল। উপায়ান্তর না দেখে সেসব বীর শব্দসৈনিক তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সহায়তায় একটি ক্ষুদ্র এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বয়ে নিয়ে এলেন মুক্তাঞ্চলে। এ ট্রান্সমিটারের সাহায্যে বিছিন্নভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল আরও কিছুদিন।

অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রচার জোরদার করার উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে সংগঠনের দায়িত্ব অর্পিত হল আবদুল মান্নানের (এমএনএ) ওপর। পরবর্তীকালে কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ চলত ছোট্ট একটা দ্বিতল বাড়িতে। অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য স্টুডিও ছিল মাত্র একটি। পরে আরও একটি কক্ষ খালি করে অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে এগুলোতে আধুনিক স্টুডিওর মতো কোনো শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রী।

কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিল কালজয়ী কিছু গান যেমন: ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘নোঙর তোল তোল’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’-এ রকম আরও অনেক গান। দ্বিতল বাড়ির নিচতলায় ছিল আমাদের রান্নাঘর, ওখানেই আমরা খেতাম। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গানের রিহার্সেল এবং রেকর্ডিংয়ের কাজ শেষ করে ওই বাড়ির দোতলায় স্টুডিওর পাশের রুমে খোলা মেঝেতেই চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়তাম আমরা।

চরমপত্র (বিশেষ ব্যঙ্গরচনা), অগ্নিশিখা (মুক্তিবাহিনীর জন্য অনুষ্ঠান), জাগরণী (উদ্দীপনামূলক গানের অনুষ্ঠান) এবং ইংরেজি ও বাংলা খবর প্রভৃতি দিয়েই শুরু হয়েছিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। চরমপত্র লিখতেন এবং পড়তেন এম আর আখতার। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা করেছিলেন আবদুল মান্নান (ভারপ্রাপ্ত এমএনএ)। অগ্নিশিখা মুক্তিবাহিনীর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, প্রযোজনা এবং নামকরণ করেন টিএইচ শিকদার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। এ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত যুদ্ধসংবাদ, সঙ্গীত ও কবিতা, নাটক, কথিকা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। এ বেতার কেন্দ্রের সরব উপস্থিতি সেই সংকটকালে সবার জন্য ছিল বড় ধরনের অনুপ্রেরণার উৎস। সেই সময়ে এ বেতার কেন্দ্রের গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুধু অনুপ্রাণিত করেনি, সেইসঙ্গে যারা বাংলাদেশে ছিলেন তাদেরও উৎসাহিত করেছে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে। গানগুলো যখন নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় তখন তাদেরও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকরা সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালির মনোবল অক্ষুণ্ন রাখার জন্য দিবারাত কাজ করেছেন। এ বেতার কেন্দ্রের একেকটি শব্দ বেরিয়ে এসেছে একেকটি বুলেট হয়ে।

স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত ধারাবাহিক চরমপত্র যে কারণে প্রতিষ্ঠা লাভ করে :

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের পরাজিত করার আনন্দ। যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রশস্ত্রে পিছিয়ে থাকলেও মনের জোরে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের মনের জোর আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি। বিদ্রূপ ও শ্লেষাত্মক অনুষ্ঠানটি রচনা ও উপস্থাপন করেছিলেন সাংবাদিক ও লেখক এম আর আখতার মুকুল। পরে অনুষ্ঠানটির প্রতিটি পর্ব গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় চরমপত্র নামেই।

চরমপত্র অনুষ্ঠানটির প্রতিটি পর্ব গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সেই বই থেকে প্রকাশিত হলো একটি অধ্যায় :

১) মেজিক কারবার। ঢাকায় অখন মেজিক কারবার চলতাছে। চাইরো মুড়ার থনে গাবুর বাড়ি আর কেচ্কা ম্যাইর খাইয়া ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোলজারগুলা তেজগাঁ-কুর্মিটোলায় আইস্যা-আ-আ-আ দম ফালাইতাছে। আর সমানে হিসাবপত্র তৈরি হইতাছে। তোমরা কেডা? ও-অ-অ টাঙ্গাইল থাইক্যা আইছ বুঝি? কতজন ফেরত আইছ? অ্যাঃ ৭২ জন। কেতাবের মাইদে তো দেখতাছি লেখা রইছে টাঙ্গাইলে দেড় হাজার পোস্টিং আছিল। ব্যস্ ব্যস্, আর কইতে হইব না—বুইজ্যা ফালাইছি। কাদেরিয়া বাহিনী বুঝি বাকিগুলার হেই কারবার কইর্যা ফালাইছে। এইডা কী? তোমরা মাত্র ১১০ জন কীর লাইগ্যা? তোমরা কতজন আছলা? খাড়াও খাড়াও—এই যে পাইছি। ভৈরব-১,২৫০ জন। তা হইলে ১,১৪০ জনের ইন্নালিল্লাহে ডট ডট ডট রাজেউন হইয়া গেছে। হউক কোনো ক্ষেতি নাই। কামানের খোরাকের লাইগ্যাই এইগুলারে বঙ্গাল মুলুকে আনা হইছিল। রংপুর-দিনাজপুর, বগড়া-পাবনা মানে কিনা বড় গাং-এর উত্তর মুড়ার মছুয়া মহারাজ গো কোনো খবর নাইক্যা। হেই সব এলাকায় এক শতে এক শর কারবার হইছে। আজরাইল ফেরেশতা খালি কোম্পানির হিসাবে নাম লিখ্যা থুইছে।
আরে এইগুলা কারা? যশুরা কই মাছের মতো চেহারা হইছে কীর লাইগ্যা? ও-অ-অ তোমরা বুঝি যশোর থাইক্যা ১৫৬ মাইল দৌড়াইয়া ভাগোয়াট হওনের গতিকে এই রকম লেড়-লেড়া হইয়া গেছো।
আহ্ হাঃ! তুমি একা খাড়াইয়া আছো কীর লাইগ্যা? কী কইল্যা? তুমি বুঝি মীরকাদিমের মাল? ও-অ-অ-অ বাকি হগ্গলগুলারে বুঝি বিচ্চুরা মেরামত করছে? গ্যাং-এর পাড়ে আলাদা না পাইয়া আরামসে বুঝি চুবানি মারছে।
কেইসডা কী? আমাগো বকশি বাজারের ছক্কু মিয়া কান্দে কীর লাইগ্যা? ছক্কু-উ, ও ছক্কু! কান্দিস না ছক্কু, কান্দিস না! কইছিলাম না, বঙ্গাল মুলুকের কোদো আর প্যাকের মাইদ্দে মছুয়াগো ‘মউত তেরা পুকুর তা হ্যায়’।
নাঃ—তখন কী চোটপাট! হ্যান করেংগা, ত্যান করেংগা। আর অহন? অহন তো মওলবি সাবরা কপিকলের মাইদ্দে পড়ছে। সামনে বিচ্চু, পিছনে বিচ্চু, ডাইনে বিচ্চু, বাঁয়ে বিচ্চু। অখন খালি মছুয়ারা চিল্লাইতাছে, ‘ইডা হামি কী করছুনুরে! হামি ক্যা নানির বাড়িত আচ্ছিনু রে! হামি ইয়া কী করনু রে!’

বিএনএনিউজ/জেবি

Loading


শিরোনাম বিএনএ