বিএনএ, চট্টগ্রাম: সীতাকুণ্ড থানা ও ফৌজদার হাট পুলিশ ফাঁড়িকে ম্যানেজ করে সীতাকুণ্ড তুলাতলী এলাকায় প্রতিদিন বিভিন্ন কোম্পানির হাজার হাজার জ্বালানি গ্যাসবিহীন নতুন সিলিন্ডার কাটা হচ্ছে। ভানুর বাজার, কুমিরাসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত কিছু অসাধু রোলিং মিল ব্যবসায়ি এসব সিলিন্ডার কাটা কিনে নিচ্ছে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশে গ্যাস সিলিন্ডার সংকট তৈরি হবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
কেন কাটা হচ্ছে নতুন গ্যাস সিলিন্ডার?
সম্প্রতি বাংলাদেশে লোহার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি কেজি লোহার দাম ৬০ টাকা। সিলিন্ডারের লোহা খুবই উন্নতমানের। সেকারণে এর চাহিদা বেশি। রোলিং মিল গুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা কথিত চনাচুর স্ক্রাপের সঙ্গে মিশিয়ে লোহার গুনগত মান বজায় রাখেন। রি-রোলিং মিলে প্রবেশ করার পর এ গ্যাস সিলিন্ডার অকেজো ও বিদেশ থেকে আমদানি করা লোহায় পরিণত হয়!
এলপিজি সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী সেটি প্রথমে ডিগ্যাসিফিকেশন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের উপস্থিত থাকার বিধান রয়েছে। তা না করে যদি এটা কাটা কিংবা ভাঙা হলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হতে পারে। কিন্তু সীতাকুণ্ডের তুলাতলীতে দিবালোকে গ্যাস সিলিন্ডার কাটা হচ্ছে।
উল্লেখ, প্রতিটি সিলিন্ডারের ওজন গড়ে ১৩ কেজি। প্রতিটি সিলিন্ডারে মুখে ২৫০ গ্রাম এর তামা রয়েছে। যা বিক্রি হয় ৭ শত টাকা কেজি দরে। সে হিসেবে একটি কাটা সিলিন্ডারের বিক্রয় মূল্য ৯৫৫ টাকা। একটি খালি সিলিন্ডার কিনতে পাওয়া যায় ৬শত থেকে ৭ শত টাকায়। অথচ গ্যাস সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ একটি নতুন সিলিন্ডার কিনে ২ হাজার ৫ শত টাকা থেকে দুই হাজার ৮ শত টাকায়। বাজারমূল্য অনেক বেশি হলেও বাজারজাতের পরিমাণ বাড়াতে গ্রাহকের ক্ষেত্রে সিলিন্ডার প্রতি ভর্তুকি দেয় গ্যাস বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রতিটি সিলিন্ডার কেটে বিক্রি করলে লাভ হয় কমপক্ষে ২ শত টাকা। গত ৩ মাসে অন্তত ১০ লাখ সিলিন্ডার কাটা হয়েছে বলে সূত্র জানায়। সে হিসেবে অন্তত: তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি!
কিভাবে সংগ্রহ হচ্ছে লাখ লাখ সিলিন্ডার?
অনুসন্ধানে জানা যায়, সারাদেশে ২৭টি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস বাজারজাত করে থাকে। এ খাতে বিনিয়োগ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ লাখ। এ সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামেও এখন এলপি গ্যাসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতা। প্রতিষ্ঠানগুলোর মার্কেটিং ম্যানেজারগণ কোন ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া প্যাকেজে যে কাউকে হাজার হাজার সিলিন্ডার দিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের সিলিন্ডারসহ ক্রয় দাম এক হাজার ৬ শত টাকা থেকে ৭ শত টাকা।
চক্রটি পান দোকান, মুদি দোকান, বিকাশ-নগদের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাব এজেন্টের মাধ্যমে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করে থাকে । যদিও এভাবে গ্যাস বিক্রি অবৈধ। সারাদেশ থেকে পরবর্তীতে খালি গ্যাস সিলিন্ডারগুলো সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেয়া হয় সীতাকুণ্ড থানার তুলাতুলিতে এলপি কুসুম সিন্ডিকেট এর কাছে। কুসুম সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে কাটা হয় গ্যাস সিলিন্ডারগুলো। এর মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিলিন্ডারই বেশি।
নিয়ম অনুযায়ী, গ্রাহকের কাছ থেকে ফেরত আসা খালি সিলিন্ডার রিফিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে পাঠাতে হয় পরিবেশকদের। তবে সম্প্রতি দেখা গেছে, খালি সিলিন্ডার ফেরত যাওয়ার পরিমাণ গাণিতিক হারে কমছে।
নেপথ্য এলপি কুসুম!
সরেজমিনে সীতাকুণ্ডের তুলাতলী গ্রামের সমুদ্র সৈকত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাকে ও কাভার ভ্যানে খালি গ্যাস সিলিন্ডার এনে জড়ো করা হয়। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ৪/৫ টি খালি জায়গায় তাবু ফেলে অন্তত ৫০টি গ্যাস কাটার দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার গুলো কাটা হয়। এসময় এলাকায় এক ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও শব্দ দূষণ দেখা দেয়। স্থানীয় জনগণ শান্তিতে ঘুমাতে পারে না।
এ গ্যাস সিলিন্ডার সিন্ডিকেটের গডফাদার হচ্ছে স্থানীয় ইসমাঈল উদ্দিন কুসুম নামে এক ব্যক্তি। তাকে এলাকায় এলপি কুসুম নামে সবাই চিনে। তার সঙ্গে রয়েছে শাহীন, মহসিন ও মাঈনুদ্দিনসহ অন্তত: ১৫ জনের একটি সিন্ডিকেট। তারা এতটাই শক্তিশালী যে এলাকার মানুষ টু-শব্দ করতে পারে না।
এ ব্যাপারে এলপি কুসুম এ প্রতিবেদককে জানান, তার জড়িত থাকার বিষয়টি সঠিক নয়। তুলাতুলি টেড্রার্স নামে তার একটা এলপি গ্যাস বিক্রির প্রতিষ্ঠান আছে। তিনি পদ্মা ও মেঘনার পরিবেশক। মাসে দুই/তিন হাজার সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি করেন। যেখানে সিলিন্ডার কাটা হয়, সেখানে এলপি কুসুম যান না বলে জানান।
খালি সিলিন্ডার ফেরত দেয়া হয় কী না এমন প্রশ্নে না সূচক উত্তর দিয়ে বলেন, কর্তৃপক্ষ আমার কাছে কখনো চায় নি! নষ্ট কিছু সিলিন্ডার তিনি বিক্রি করেছেন বলে স্বীকার করেন। নষ্ট সিলিন্ডার বিক্রি করার এখতিয়ার পরিবেশকের নেই এমন প্রশ্নে তিনি জানান, বিষয়টি তার জানা নেই।
মহসিন, শাহীন ও মঈনুদ্দিন মেম্বার, তার সিন্ডিকেট সদস্য এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, তারা গ্যাস সিলিন্ডার কাটা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়। মঈনুদ্দিন মেম্বার অনেকবার নিষেধ করেছে, কিন্তু তার কথা কেউ শুনে না। এক পর্যায়ে সাংবাদিকরা তার কাছে যান বলে জানান।
পুলিশের মাসেহারা ৪ লাখ টাকা!
এলপিজি কুসুমের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট প্রতি সপ্তাহে ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়িকে ৫০ হাজার টাকা, সীতাকুণ্ড থানা পুলিশকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দেন বলে লোকমুখে প্রচার রয়েছে। সে হিসেবে মাসে থানা পুলিশ পাচ্ছে ৪ লাখ টাকা। এছাড়া যে সব রি-রোলিং মিল এসব কাটা গ্যাস সিলিন্ডার কিনছে, তারাও মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিচ্ছে পুলিশকে! ফলে প্রকাশ্য এলপি গ্যাস সিলিন্ডার কাটার রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যেতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না! তবে সীতাকুণ্ড থানা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
শুধু পুলিশ নয়, পরিবেশ ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের নাম ভাঙ্গিয়ে কতিপয় ব্যক্তি সাপ্তাহিক চাঁদা সংগ্রহ করে থাকে। অভিযোগ আছে, কথিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও।
মামলা, অভিযোগে টনক নড়েনি!
সম্প্রতি কুমিল্লার কোটবাড়ি বিশ্বরোডের সফিউল আলম স্টিল মিলসের সামনে থেকে বেশ কয়েকটি কোম্পানির ৪ হাজার ৩২৪টি সিলিন্ডার এবং এর কাটা অংশ জব্দ করা হয়। আনুমানিক ৫৬ হাজার ২১০ কেজি ওজনের এসব সিলিন্ডারের দাম ৪৩ লাখ টাকার বেশি। সাতটি ট্রাকে সীতাকুণ্ডের তুলাতলী থেকে সিলিন্ডার কাটাগুলো নেয়া হয় বলে সূত্রে প্রকাশ। এ ঘটনায় একটি মামলাও হয়। এতে বলা হয়, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা যায়নি।
সিলিন্ডার বিধিমালা-১৯৯১ তে কী আছে?
বাজারে পাওয়ায় এমন গ্যাস সিলিন্ডারের মেয়াদ আনুমানিক ২০ বছর।বিস্ফোরক আইন অনুযায়ী বাজারজাতকারক প্রতিষ্ঠানও অনুমোদন ছাড়া সিলিন্ডারের আকার পরিবর্তন এবং বিকল্প ব্যবহার করতে পারে না। অথচ আইনের তোয়াক্কা না করেই অবাধে সিলিন্ডার কাটার রমরমা ব্যবসা চলছে।
সিলিন্ডার বিধিমালা-১৯৯১-এ স্পষ্ট লেখা আছে, কোনো অবস্থায়ই সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ, কাটা কিংবা আঘাত করা যাবে না। সিলিন্ডার নষ্ট হয়ে গেলে সেটি কাটতে বা ভাঙতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তা করতে হবে। বিধিমালায় বলা হয়েছে, এলপিজি অপারেটর ও গ্যাস-সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে একটি সিলিন্ডার ১০ বছর পরপর পরীক্ষা করাতে হবে। সে সময় সেটির নির্দিষ্ট মান বজায় থাকলে এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরের ছাড়পত্র পেলেই তা আবারো ব্যবহার করা যাবে।
বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে?
দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবেশক, খুচরা ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানির রিফুয়েলিং স্টেশনে ২৭টি অপারেটরের সাড়ে তিন কোটি সিলিন্ডার রয়েছে। এলপি গ্যাসে বড় বিনিয়োগ থাকে সিলিন্ডারে। দীর্ঘদিন ব্যবসা করে সেই মুনাফা তুলে আনেন বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই চড়া দামের সিলিন্ডার এক দুই বছরের মধ্য স্ক্র্যাপে পরিণত হচ্ছে।
এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) পক্ষ থেকে সিলিন্ডার কাটা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে আবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি কাটা সিলিন্ডার না কিনতে রি-রোলিং মিল মালিকদের চিঠি দিয়েছে। কিছু গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে গ্যাস সিলিন্ডার কাটা অব্যাহত রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার থেকে সিলিন্ডার কিনে তা কেটে বিক্রির প্রক্রিয়াটি একেবারেই অবৈধ। এ ধারা চলতে থাকলে এলপিজি খাত হুমকিতে পড়বে। বাজারে সিলিন্ডার না থাকলে গ্রাহক সঠিক সময়ে পণ্য পাবেন না। সিলিন্ডার কাটা বন্ধ না হলে সম্ভাবনাময় একটি বিশাল খাত হুমকিতে পড়বে। দীর্ঘমেয়াদে লোকসানে পড়ে দেউলিয়া হয়ে যাবে অনেক প্রতিষ্ঠান।
বিএনএ/মনির ফয়সাল,ওয়াই এইচ