বিএনএ, ঢাকা: রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র, ৭২ সালের সংবিধান বাতিল, আওয়ামী লীগ-জাতীয়পার্টি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবিতে সোচ্চার ছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জামায়াত ভিতরে ভিতরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এসব দাবির প্রতি সমর্থন দিলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল –বিএনপি এসব দাবির প্রতি সমর্থন দেয়নি।
ফলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিভিন্ন সময় তোলা দাবি গুলো আতুঁড় ঘরে মারা যায়। বিএনপির সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে বৈরিতা তৈরি হয়। বৈষম্য বিরোধী সমন্বয়করা রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেয়ার পর এই বৈরিতা চরম আকার ধারণ করে। সমন্বয়করা বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে কটাক্ষমূলক নানা বক্তব্য দিতে শুরু করে।
বিএনপির অভিযোগ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পৃষ্টপোষকতায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করছে। সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যদি অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন কন্ডাক্ট বা পরিচালনা করা পর্যন্ত থাকবে। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।’ জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া ছাত্ররা রাজনৈতিক দল করতে চাইলে তাদের প্রতিনিধিনিদের সরকার থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ।
বিএনপি মহাসচিবের এই মন্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটি এক–এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে।
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বিএনপি কয়েক দিন আগে ‘মাইনাস টুর’ আলোচনা করলেও এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য নিরপেক্ষ সরকারের নামে আরেকটি এক-এগারো সরকারের প্রস্তাব করছে। এ ধরনের পরিকল্পনা গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে এবং ছাত্র-জনতা কোনোভাবেই এটা মেনে নেবে না। এটা বিএনপির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র।
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘ছাত্র এবং অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে মাইনাস করার পরিকল্পনা, ৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়েছে। ৫ আগস্ট যখন ছাত্র-জনতা রাজপথে লড়াই করছে, পুলিশের গুলি অব্যাহত রয়েছে, তখন আমাদের আপোসকামী অনেক জাতীয় নেতা ক্যান্টনমেন্টে জনগণকে বাদ দিয়ে নতুন সরকার করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন। ৩রা আগস্ট থেকে বলে আসছি, আমরা কোনো প্রকারের সেনাশাসন বা জরুরি অবস্থা মেনে নেব না। আমাদেরকে বারবার ক্যান্টনমেন্টে যেতে বলা হলেও আমরা যেতে অস্বীকার করি। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে আলোচনা ও বার্গেনিংয়ের মাধ্যমে অধ্যাপক ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।’
নাহিদ ইসলাম আরও লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ বিষয়ে ভারতের প্রধান দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সম্ভব হয়েছে, অথচ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিষয়ে আমরা ঐক্য করতে পারিনি এত হত্যা এবং অপরাধের পরেও। হায়, এই “জাতীয় ঐক্য” লইয়া আমরা কী রাষ্ট্র বানাব!
বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের পাল্টাপাল্টি এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, রাজনৈতিক অঙ্গন নতুন করে সরগরম হয়ে ওঠেছে। অনেকের প্রশ্ন, উপদেস্টা নাহিদ ইসলাম ‘আরেকটি এক–এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত’ বলতে কী, নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও জরুরি অবস্থা জারির সম্ভাবনার কথা, বুঝাতে চেয়েছেন?
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তত্কালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর, রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু নিরপেক্ষতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকলে সরকারের চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। নিয়োগ দেয়া হয় নতুন উপদেষ্টা।
এ পরিস্থিতিতে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়। তত্কালীন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন তিনি। জেনারেল মইন ইউ আহমেদ নিজেই এক অনুষ্ঠানে ১১ জানুয়ারির জরুরি অবস্থা জারির দিনটিকে ’ওয়ান-ইলেভেন’ বা এক-এগারো নামে আখ্যায়িত করেন।
বিএনপির চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভাপতিকে সাবজেলে আটক রাখা হয়। সংস্কারের নামে দুই নেত্রীকে রাজনীতির বাইরে পাঠাতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকরের চেষ্টা চালানো হয়। রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন ও দূর্নীতি দমনের নামে সেনা সমর্থিত এই ’ওয়ান-ইলেভেন’সরকার ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
গত সাড়ে ৫ মাসেও জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, আইন শৃঙ্খলার অবনতি, চাঁদাবাজদের দৌরাত্য কমাতে না পারা, বাজেটের আগেই ইচ্ছানুয়ায়ি ভ্যাট- ট্যাক্স আরোপ, জাতীয় ইস্যূতে ঐক্যমতের অভাব ও সংস্কারের নামে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা, ছাত্রদের দল গঠনে পৃষ্টপোষকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা সহ নানা বিষয়ে, দিন যতই যাচ্ছে, ততই জনপ্রিয়তা কমছে বর্তমান সরকারের।
একদিকে সরকারের নানা ব্যর্থতা, অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতবিরোধ, সমন্বয়কদের মধ্যে গ্রুপিং, মারামারির প্রেক্ষাপট, দেশকে ’ওয়ান-ইলেভেন’ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
সৈয়দ সাকিব