বিএনএ, ঢাকা : বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যেই ভারত থেকে জিটুজি পদ্ধতিতে আমদানি করা ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল গত শনিবার বন্দরে এসে পৌঁছেছে। আগামী এক মাসের মধ্যে আরো এক লাখ টন চাল একই পদ্ধতিতে ভারত থেকে দেশে এসে পৌঁছাবে।
প্রয়োজনে ভারতের বাইরেও অন্য দেশ থেকে চাল আমদানি করে সরকারি মজুদ বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। আর এসব আমদানিকৃত চাল সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যবহার করে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো হবে। এতে চালের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে চালের দাম কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। গত বেশ কিছুদিন ধরেই চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। যে মৌসুমে মাঠের ধান কৃষকের গোলায় উঠছে, সে সময়ে বাজারে চালের এই মূল্য বৃদ্ধি সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গতানুগতিক আদেশ-নির্দেশের পরেও চালের বাজারে কোনো পরিবর্তন আসেনি, কমেনি চালের দাম, উল্টো আরো বেড়েছে। চালের সরবরাহ বাড়ানো এবং দাম কমানোর বিষয়ে মিলারদের প্রতি বিভিন্ন হুমকি-ধমকি, আদেশ-নির্দেশ, অনুরোধ করলেও তাতে তারা কর্ণপাত করেনি।
নানা জটিলতা কাটিয়েও এ বছর আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় দাবি করলেও এ তথ্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, এ বছর বন্যায় পানিতে ভেসে আসা পলির কারণে ধানের গাছ উর্বর হয়েছে।
মাঠের পর মাঠ সবুজের সমারোহে ছেয়ে ছিল ঠিকই, কিন্তু উৎপাদন কম হয়েছে। প্রতি একরে ৪০ মণ ধান হওয়ার কথা থাকলেও এ বছর ২৫ থেকে ২৬ মণের বেশি কোথাও ধান উৎপাদন হয়নি। তাই আসলে ধানের উৎপাদন কম হয়েছে।
এ কারণেই চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ধানের সরবরাহ হচ্ছে না। এতে ধানের দাম অতীতের অনেক বছরের তুলনায় বেশি। গত ১৯ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে ১২২০ টাকা দরে। ধানের দাম বেশি হলে চালের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছেন বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। দেশের সর্বত্র সরকারের (খোলা বাজারে বিক্রি) ওএমএস কার্যক্রম না চললেও যেসব জেলায় চলছে সেসব জেলায় তা চালানোসহ আরো কিছু কর্মসূচি গ্রহণের পরিকল্পনা করছে সরকার।
এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে দেয়া হবে চাল। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেলে কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) আবারো পরিবর্তন করে কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে বাজারে সরকারের আমদানি করা চালের সরবরাহ ব্যাপকহারে বাড়বে। যা দাম কমার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
জানা গেছে, এই সময়ে বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। গত যেকোনো সময়ের তুলনায় এই সময়ে মোটা চালের দাম তুলনামূলক কম থাকলেও এবার সমানতালে বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। ফলে নিম্নআয়ের মানুষকে পড়তে হয়েছে কিছুটা বিপাকে।
করোনাপরবর্তী সময়ে অনেকেরই আয়-রোজগারে ভাটা পড়েছে। অনেকেই হয়েছেন বেকার। কারো কারো আয় কমেছে অর্ধেকের বেশি। এমন পরিস্থিতিতে অপ্রত্যাশিতভাবে চালের এই মূল্য বৃদ্ধি জীবনযাত্রা পরিচালনায় বেগ পেতে হচ্ছে। এদের বেশির ভাগই নিম্নমধ্য আয়ের মানুষ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, নিয়মিত বাজার মনিটরিং চলছে। তবে চালের বাজার দেখভাল করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সরকারি পর্যায়ে জিটুজি পদ্ধতিতে চাল আমদানি হচ্ছে। এসব চাল বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বাজারে চালের সংকট কৃত্রিম। অধিক মুনাফার আশায় তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করছে। এতে ধানের দাম বেড়েছে। তবে এ দাম আর বাড়বে না বলেও জানিয়েছেন তারা।
চালের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা মিল মালিকদের দায়ী করছেন। মিল-মালিকরা বলছেন, ধানের দাম বেশি হলে চালের দাম কম হবে কীভাবে? ১২ শ টাকা মণ দরে ধান কিনলে চালের বাজার তো চড়বেই।
তারা বলছেন, আরো বেশি দাম পাওয়ার আশায় অনেকেই ধান বিক্রি করছেন না। এতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে (২০১০-১১ অর্থবছর) প্রতি কেজি (মাঝারি মানের) চালের গড় দাম ছিল ৪১ টাকা, যা বর্তমান বাজারে ৬০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। গত অর্থবছরও (২০১৯-২০) প্রতি কেজি চালের গড় দাম ছিল ৫৬ টাকা। গত এক দশকের মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের আগ পর্যন্ত চালের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৪৬ টাকা।
এরপর হঠাৎ করেই পরের বছর চালের দাম ৫৩ টাকায় ওঠে। পরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দাম এক টাকা কমেছিল। কিন্তু এরপর আবার চালের দাম লাগাম ছাড়া হয়।
তথ্য বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর পরবর্তী বছরগুলোতে চালের দাম ছিল যথাক্রমে ৫৩ টাকা, ৫৫ টাকা, ৫৭ টাকা ও ৫৬ টাকা।
কৃষি অধিদফতরের তথ্যমতে এক দশক আগেও দেশে চালের উৎপাদন ছিল তিন কোটি ৩৫ লাখ টন, যা এখন (২০১৯-২০ অর্থবছর) তিন কোটি ৮৭ লাখ টনে এসে দঁাড়িয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পরে প্রতি বছর চালের উৎপাদন প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টন করে বেড়েছে।
বিএনএনিউজ/ আরিফুল/ এইচ.এম।