।।এনামুল হক নাবিদ।।
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল)। সিইউএফএল একটি বিসিআইসির কেপিআই১ গ্রেডের প্রতিষ্ঠান হলেও এখানে দুর্নীতি- অনিয়ম চলে সমানে সমান। সরকার বিদেশ থেকে সার আমদানি করলেও গ্যাস সংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটির নামে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সার কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকে বছরের পর বছর। মূলত কারখানাটির যান্ত্রিক কোন সমস্যা দেখা দিলে সেটির মূল কাজ করে থাকে কারখানার প্ল্যান্ট এন্ড সপ (পিএন্ডএস) শাখা। আর এই প্ল্যান্ট মেন্টেন্যান্স শাখার ইন-চার্জ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চেয়ারে ছিলেন উপ-প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক)- সৌমিত্র সাহা। আর তিনি এই শাখাকে করেছেন দুর্নীতি ও লুটপাটের আঁতুড়ঘর।
কারখানার গুরুত্বপূর্ণ এই শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এই উপ-প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে রয়েছে কারখানার নানা অনিয়মের অভিযোগ। বিশেষ করে যন্ত্রপাতি কেনাকেটার নামে গত দুই তিন বছরে কোটি কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবুও তিনি ছিলেন বহাল তবিয়তে। তার সিন্ডিকেটের কাছে হার মেনেছেন মুরালী মোহন বিশ্বাস নামের দক্ষ এক প্রকৌশলীও। এই সৌমিত্র সাহা এই শাখা প্রধানের চেয়ার দখল নিতে তাকে কায়দা করে এমডির দপ্তরে বদলি করেছেন।
কারখানার সচেতন প্রকৌশলীরা এর প্রতিবাদ করলেও তার শক্ত সিন্ডিকেটের কাছে এসব অনিয়ম ও লুটপাট ধামাচাপা পড়েছে। অবশেষে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত এই প্ল্যান্ট মেন্টেন্যান্স শাখার ইন-চার্জ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চেয়ারে থাকা উপ-প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক)- সৌমিত্র সাহাকে এবার শাখা প্রধান থেকে সরিয়ে এমটিএস বিভাগের দপ্তরে সম্পৃক্ত করা হয়। গত ১৬ নভেম্বর সিইউএফএলের এক বিভাগীয় দপ্তরাদেশে শাখা প্রধান থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। যার সূত্র নং ১৯১৩০/৫২৯৭। তার জায়গায় শাখা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী (যাঃ) মোহাম্মদ মোন্তাসির মামুনকে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে মোহাম্মদ মোন্তাসির মামুন, নির্বাহী প্রকৌশলী (যাঃ) পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত প্ল্যান্ট মেন্টেন্যান্স শাখার শাখা প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন ।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) ও বিভাগীয় প্রধান (এমটিএস) শাখার প্রকৌঃ মোঃ শাহজাহান কবীর স্বাক্ষরিত এ দপ্তরাদেশ দেওয়া হয়। তবে কি কারণে তাকে শাখা প্রধান থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ না করলেও একটি সূত্র বলছে নানা অনিয়ম ও যন্ত্রাংশ কেনার নামে টাকা লুটপাটের অভিযোগে তাকে শাখা প্রধান থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ দিকে এই নতুন প্ল্যান্ট মেন্টেন্যান্স শাখার ইন-চার্জ যাকে করা হয়েছে প্রকৌশলী(যাঃ) মোহাম্মদ মোন্তাসির মামুনকে গত ২ নভেম্বর বিসিআইসির ডেপুটি চীফ অফ পার্সোনাল মো মাসুদ পারভেজ স্বাক্ষরিত এক আদেশে ইউজিএসএফএল কালুরঘাট থেকে তাকে সিইউএফএলে আনা হয়েছে। যার বিসিআইসির স্মারক নং ৩৬.০১.০০০০.১১৭.১৭।
এই দপ্তরাদেশের পর এদিকে গত (২১ ও ২২ নভেম্বর) বিসিআইসির চিফ অব পার্সোনালের পক্ষে ডেপুটি চিফ অব পার্সোনেল মোঃ মাসুদ পারভেজ স্বাক্ষরিত দুই দপ্তরাদেশে সৌমিত্র সাহাকে এমটিএস শাখা থেকে বদলি করা হয় সুনামগঞ্জে। সাথে আরো দুই কর্মকর্তাকে বদলির আদেশ দেয়া হয়। তবে দপ্তরাদেশে কী কারণে তাদের বদলি করা হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি। এর মধ্যে উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) এস, এম আব্দুল্লাহ আল মামুন (৫০৮৬-৪) কে কর্ণফুলী পেপার মিলস্ লিমিটেড (কেপিএমএল) বদলি করা হয়। অপর কর্মকর্তারা হলেন উপ-প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সৌমিত্র সাহা (৫১৫৩-২) এবং সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম (৫৫০৯-৫) ।এদের সিসিসিএল ছাতক, সুনামগঞ্জে বদলি করা হয়।
সিইউএফএল সূত্র বলছে, ১৯৮৭ সাল থেকে কারখানার উৎপাদন শুরু হওয়ার পর নিয়মিতভাবে ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯২, ১৯৯৫, ২০০৩, ২০০৫ এবং সর্বশেষ ২০০৭ সালে ওভারহলিং কাজ সম্পাদিত হয়েছিল। সদ্য সমাপ্ত কারখানার ওভারহলিং-২০২১ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে গত ২০২০ সালের ২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত ওভারহলিং সংক্রান্ত প্রথম কারিগরি সভায় বিভাগীয় প্রধান, শাখা প্রধান এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ২০ (বিশ) সদস্য বিশিষ্ট ওভারহলিং-২০২১ কমিটি গঠিত হয়। আর এই কমিটির সদস্য সচিব হন প্ল্যান্ট মেন্টেন্যান্স শাখার ইন-চার্জ উপ-প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক)- সৌমিত্র সাহা। ওভারহলিং-২০২১ কার্যক্রম ২০২১ সালের ২০ মে খ্রি. হতে শুরু হয়ে ২৩ জুন পর্যন্ত ৩৫(পঁয়ত্রিশ) দিনে সম্পাদন করা হয়।
ওভারহলিং-২০২১ কার্যক্রমের আওতায় এমটিএস বিভাগের পিএন্ডএস শাখার তত্ত্বাবধানে অ্যামোনিয়া প্ল্যান্টসহ কারখানার যাবতীয় কাজ করা হয়। কেনাকাটা করা হয় কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ। এই কেনাকাটাকালে সদস্য সচিব সৌমিত্র শাহার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
দেখা যায়, ওভারহলিং সময় বিসিআইসি পত্র নং ৩৬.০১.২৬৫৪.৩২১.০৭.০০২.২১.৫০০ এখানে চাহিদাকৃত ইন্টারনাল পার্টস সংগ্রহের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছে এ সৌমিত্র সাহা। এছাড়াও দেখা গেছে, ২০২১ অর্থবছরে ওভারহলিং রক্ষণাবেক্ষণ নামে মালামাল ক্রয়ে হয়েছে নানা অনিয়ম। কারখানা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এখানে ওভারহলিং সময় যে টুলস ব্যবহার হয়েছে তা পুরোনো এবং কারখানার কাজে ব্যবহার হয়নি। যদি হয় তাদের মতে একবার ওভারহলিং হওয়ার পর ৪-৫ বছরে আর কাজ করতে হয় না। তবে গত ২২-২৩ অর্থবছরে শত শত কোটি টাকার ফের টুলস ক্রয় করা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ক্রয় করা এসব টুলস ও মালামাল কারখানা থেকে হাওয়া হয়ে যায়। যার ফলে কারখানা যে লাউ সেই কদু থেকে যায়। যার ফলে ফের দেখা দেয় যান্ত্রিক সমস্যা।
এ দিকে অগ্নিকাণ্ড ও গ্যাস সংকটের কারণে দীর্ঘ এক বছর বন্ধ ছিল সিইউএফএল। ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর সকাল ৯টার দিকে সিইউএফএলের প্রাইমারি রিফরমারি ওয়েস্টেস বয়লারে আগুনের সূত্রপাত হয়। এর যান্ত্রিক ত্রুটি ও গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ ছিল দীর্ঘ এক বছর।
কারখানার সূত্র জানায়, গত বছরের ২২ নভেম্বর কারখানার বয়লারে আগুন লাগার পর ইউরিয়া সার ও অ্যামোনিয়া উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। মেরামত শেষে চার মাস পর গত ২২ মার্চ উৎপাদন শুরু হলেও পাঁচ দিনের মাথায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আবারও বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। এরপর যুক্তরাজ্যের একটি বিশেষজ্ঞ দলের তত্বাবধানে মেরামত কাজ করে উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হলেও গত ৫ মে থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে গ্যাস সংকটের কারণে প্লান্টের ক্যাটালিস্ট রিডাকশন প্রকল্পের ট্রায়াল শেষ করতে পারেনি। ট্রায়াল শেষ করতে এক মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে ৪২ এমএমসিএফডি গ্যাসের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় ক্যাটালিস্ট রিডেকশনের ট্রায়ালও শেষ করতে পারেনি যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ দলটি।
জানা গেছে, গত ৭ অক্টোবর থেকে ১২ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার পর উৎপাদন প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করেছিল কর্তৃপক্ষ। পরে ক্যাটালিস্ট রিডাকশনের ট্রায়াল শেষ করতে চলতি মাসের ১৫ অক্টোবর আসে যুক্তরাজ্যের ৪ বিশেষজ্ঞ দল।
এ দিকে গত এক বছর কারখানা বন্ধ থাকায় কারখানাটির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২শ কোটি টাকা। এরপর ট্রায়াল কাজ শেষে গত ৫ নভেম্বর থেকে পুরোদমে সার উৎপাদন উৎপাদন শুরু করে সিইউএফএল।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে গত এক বছরে কারখানা মেরামতের নামে লুটপাট করা হয়েছে শত শত কোটি টাকা। এছাড়াও সিইউএফএল এ ইউরিয়া প্লান্টের কাজে হয়েছে বড় ধরনের অনিয়ম। অন্যবার নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান বিটাকের মাধ্যমে কাজ করা হলেও এবার জাপানের ওসাকা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের লোকাল এজেন্ট থেকে এসব যন্ত্রাংশ ক্রয় করা হয়েছে। এসব যন্ত্রাংশ কেনা কেটায় প্ল্যান্ট মেন্টেন্যান্স শাখার ইন-চার্জ উপ-প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক)- সৌমিত্র সাহার নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেটে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে । সচেতন সিইউএফএল কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতারা মনে করছেন, বিসিআইসি ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সৌমিত্র সাহাসহ এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধ ওঠা অনিয়ম তদন্ত করলে দুর্নীতির প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে আসবে।
অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠা সৌমিত্র সাহার কাছে এসব বিষয় জানতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এদিকে সিইউএফএলের এসব অনিয়মের বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, আসলে আমাদের দেশটা একটি কৃষি প্রধান দেশ। আর এখানে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর একটি সারকারখানা কথায় কথায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যাবে তা দুঃখজনক। মূলত এখানে জবাবদিহিতা নাই বলে একটি চক্র হরিলুটের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করছে। কারখানা সরকার যেখানে যাবে যাক এক শ্রেণীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আখের গোছাতে ব্যস্ত। ফলে লাভ জনক প্রতিষ্ঠান হলেও এসব অনিয়মের কারণে লস প্রজেক্টে পরিণত হচ্ছে। আমরা সচেতন নাগরিক হিসেবে আশা করব শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বিসিাইসি কারখানার এসব সিন্ডিকেট খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনবে। তবে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হবে।
এ সব বিষয়ে সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে গতানুগতিক অনুযায়ী তাকে দপ্তরাদেশ করা হয়েছে। আমি পরে এসেছে এখানে। ২১-২২ অর্থবছরের ওভারহলিং বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।
বিএনএনিউজ২৪ডটকম