স্পোর্টস ডেস্ক: গত কয়েক বছরে দেশের ক্রিকেটে একটা খুব জনপ্রিয় শব্দ হলো-পঞ্চপাণ্ডব। মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম -বাংলাদেশের ক্রিকেটের পাঁচ স্তম্ভ।
বাংলাদেশ দল থেকে মাশরাফির বিদায়ের পর ভেঙে গেছে পঞ্চপাণ্ডবের বৃত্তটা, যারা একসঙ্গে খেলেছেন একশর বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি এ পাঁচ তারকা ক্রিকেটারই ছিলেন বাংলাদেশ দলের প্রধান ভরসা। দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাশরাফি। সাকিব–মাশরাফি–তামিম–মাহমুদউল্লাহ ছিলেন তার চার গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।
পাঁচজনের একজন মাশরাফি বিদায় নেওয়ার পর কেমন জানি এক শূন্যতা তৈরি হয়ে গেল। বাকি চারজন আছেন ঠিকই কিন্তু এক হতে পারছেন না। ইনজুরিসহ নানান ঝামেলায় একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে না সাকিব-মুশফিক-তামিম-মাহমুদউল্লাহকে। চোটের কারণে অনেকদিন ধরেই দলের বাইরে তামিম। অন্যদিকে সাকিব ও মুশফিকও নানান কারণে অনিয়মিত। শুধু মাহমুদউল্লাহই পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে নিয়মিত।
সাকিব–তামিম–মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর বয়স এখন ৩৪-৩৫। পঞ্চপাণ্ডবের বৃত্ত তো ভাঙল, কিন্তু এরাও যদি বিদায় নেন, কী হবে বাংলাদেশের। আদৌ এ পাঁচ তারকার বিকল্প তৈরি হবে তো। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান দুর্দশায় ঘুরে ফিরে আসছে এই একই প্রশ্ন। পাকিস্তানের বিপক্ষে তরুণ দল নিয়ে যেভাবে ভুগছে টাইগাররা তাতে বোঝাই যাচ্ছে দলে সিনিয়র ক্রিকেটারের কোনো বিকল্প নেই।
মাশরাফির নেতৃত্ব যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট বাংলাদেশ খেলেছে, সেই খেলা আর শেষ কবে খেলেছে টাইগাররা। নতুন অধিনায়কের নেতৃত্বেও কি সেই একই ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলবে? এই প্রশ্নের উত্তর এখন অনেকটাই স্পষ্ট। একটা সময় দলে পঞ্চপান্ডবের বাকিরাও থাকবেন না। তখন এটির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াই হবে বাংলাদেশের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ।
সেই চ্যালেঞ্জ কীভাবে উতরাবে বাংলাদেশ, সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে আপাতত পঞ্চপাণ্ডবের ভাঙনে বাংলাদেশের ক্রিকেট যে পেছনের দিকে ফিরে যাচ্ছে সেটি বলাই যায়।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন- কারা হবেন পঞ্চপান্ডবের বিকল্প, যারা কিনা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবেন? এ বিষয়ে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বেশ কয়েকদিন আগেই গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘আমার মনে হয় এখন মাশা আল্লাহ ইয়াং অনেকগুলা প্লেয়ার আছে। আমি যদি নাম নিতে চাই- লিটন, সৌম্য, আফিফ, সাইফউদ্দিন। এরা খুবই অসাধারণ ক্রিকেটার। আমি আশা করব ৫ জন না, ১১ জন সলিড কন্ট্রিবিউটর হবে বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে।’‘আমি পার্টিকুলারলি এই চারজনের নাম বললাম, আরো অনেক প্লেয়ার আছে। মিরাজের কথা বলবো, মিরাজ খুব ভাল একজন অলরাউন্ডার হতে পারে। মোসাদ্দেক আছে, সে খুব ভাল ফিনিশার হতে পারে।’‘তো আমাদের হাতে অপশন আছে। আমি আশা করব তারা নিজেদের জন্য ও দলের জন্য দারুণ কিছু করবে।’
এর আগে তামিম ইকবাল জানিয়েছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি আছে (পঞ্চ পান্ডব হওয়ার মত ক্রিকেটার)। লিটন, সৌম্য, মোস্তাফিজ এখন অভিজ্ঞ। চার- পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলেছে তারা। তরুণ বলব নাজমুল হোসেন শান্তকে। এখন ওদের পারফরম্যান্স করার সময়।’
যদিও মাহমুদউল্লাহ-তামিমের কথার সঙ্গে বাস্তবতাকে একেবারে মেলানো যাচ্ছে না। যাদেরকে পঞ্চপাণ্ডবের বিকল্প ধরে রেখেছেন, তাদের তো দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ দিয়ে আসছিল বিসিবি। কিন্তু ধারাবাহিক ব্যর্থতা নিশ্চয়ই কোনো ক্রিকেটারের জন্যই সুখকর নয়। বার বার সুযোগ দেওয়ার পরও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন লিটন-সৌম্য। এরপরও অভিজ্ঞতাকে বিবেচনা করে বিশ্বকাপের স্কোয়াডেও রাখা হয়েছিল দুজনকে। কিন্তু দুজনই চরমভাবে হতাশ করেছেন। শেষমেষ দল থেকেই বাদ পড়ে গেলেন।
এদিকে সাইফউদ্দিন তো আজ খেলছেন তো কাল চোটে পড়ছেন। যাকে ভালো ফিনিশার ভাবা হতো সেই মোসাদ্দেকও ফর্মে নেই। যার কারণে একবার দলে সুযোগ পাচ্ছেন তো আবার বাদ পড়ে যাচ্ছেন। আবার আফিফ দলে আছেন ঠিকই কিন্তু এখনো ঠিকঠাক নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন না। অন্যদিকে নাজমুল শান্ত তো অনেক দিন পর দলে সুযোগ পেলেন। তার কাছ থেকেও কিছু পেতে হলে অবশ্যই নিয়মিত দলে সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ দলে সেই সুযোগও নাই। কাউকে অতিরিক্ত সুযোগ দেওয়া হবে আর কাউকে এক-দুই ম্যাচ পরখ করেই বিদায় দেওয়া হবে। এ নীতিতেই চলছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
অন্যান্য দলগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যায়, দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা যখন বিদায় নেয়, সেই ঘাটতি পূরণ করতে অনেক বেশি হিমশিম খেতে হয়। এই যেমন পাকিস্তানের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার, আফ্রিদি, মিসবাহ, ইউনুস খান, ওমর গুলদের মতো তারকারা বিদায় নেওয়ার পর টানা ব্যর্থতার বৃত্তে ছিল পাকিস্তান। কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে দলে তরুণদের সুযোগ দিয়ে অবশেষে তারা এখন পরিণত একটি দল।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালে দেখা যায় মাহেলা জয়বর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, দিলশানের মতো তারকাদের বিদায়ের পর রীতিমতো দুর্বল দলে পরিণত হয়েছে শ্রীলঙ্কা। পুরনো রূপে ফিরতে বেশ বেগ পাচ্ছে দলটি। অর্থাৎ কিংবদন্তী এসব খেলোয়াড়দের বিদায়ে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে সেটি পুষিয়ে উঠতে না পারায় প্রতিনিয়তই ধুকতে হচ্ছে তাদের। সাঙ্গাকারা-মাহেলাদের মতো কিংবদন্তীদের বিকল্প খুঁজে পায়নি লঙ্কানরা। সহজেও পাবেও না এরপরওতরুণদের প্রতি আস্থা রেখেই নিজেদেরকে পুরনো রূপে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে ৯৬ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।
পঞ্চপাণ্ডবের বিদায়ের পর বাংলাদেশ দলেরও যে সেই অবস্থা হবে সেটি অনেকটাই অনুমেয়। তাই এখন থেকেই পঞ্চপাণ্ডবের যোগ্য বিকল্প খোঁজা এবং তৈরি করা উচিৎ। রাতারাতি সেটি সম্ভব নয়। কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি তরুণদের যোগ্য উত্তরসূরি করে গড়ে তোলার দায়িত্বটা নিতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকেই। তাহলেই হয়তো বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে দল। না হলে আগামী কয়েক বছর বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের মনে ঘুরেফিরে একটা প্রশ্নই আসবে আদৌ পঞ্চপাণ্ডবের বিকল্প তৈরি হবে কি?
বিএনএনিউজ২৪/এমএইচ