।। রেহানা ইয়াছমিন ।।
গত বছরের ৫ আগষ্টের পর থেকে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়েছে। বাড়ি-ঘর ভাংচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনাতো নিত্যদিনের। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও, সন্ত্রাস-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
চাহিদামতো চাঁদা না দিলে নিয়ে যায় হালের গরু, এমনকি ফসলি জমির মাটিও। যা ইটভাটায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। আর এইসব খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে বিএনপির দুইজন প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সাড়ে ১৫ বছর রাউজানে ছড়ি ঘুরিয়েছেন সে সময়ের এমপি আওয়ামী লীগ নেতা ফজলে করিম চৌধুরী। গত ৫ আগস্ট পালাবদলের পর কারাবন্দি হন ফজলে করিম। তাঁর সাম্রাজ্য দখলে নিতে মরিয়া এখন উত্তর জেলা বিএনপি আহবায়ক গোলাম আকবর খন্দকার এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে এ দুই নেতার নির্দেশে তাদের অনুসারীরাই রাউজানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। উভয় নেতার কাছে সন্ত্রাসীরা এখন পাচ্ছে ‘ভিআইপি মর্যাদা’!
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে শক্তি দেখাতে ব্যস্ত বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা। স্থানীয়রা বলছেন, উত্তর রাউজানে গিয়াস কাদেরের সমর্থনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন রফিকুল আলম বাচা, আজিজুল হক ও আজিজ উদ্দিন। দক্ষিণ রাউজানে বিধান বড়ুয়া, মোশারফ হোসেন ছোটন, কামাল উদ্দিন ও আবু তাহের। গোলাম আকবরের সমর্থনে উত্তর রাউজানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন ইকবাল ও জমির। দক্ষিণে হাজী আজিজুল হক ও জানে আলম।
গত ২৮ আগস্ট থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী নিহত হয়েছেন প্রতিপক্ষের হামলায়, আর বাকি ৭জনের মৃত্যু হয়েছে বিএনপির উপদলীয় কোন্দলে। অন্তর্দলীয় সংঘাতে আহত মানুষের সংখ্যা দুই শতাধিক, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত এক শ জন। এসব ঘটনায় ব্যবহার হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। একের পর এক খুন, সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। ধরা পড়ছে না জড়িতরা। তবে হত্যায় জড়িতরা এলাকায় ঘুরলেও পুলিশ ধরছে না বলে অভিযোগ স্বজনদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনা ঘটলেও হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ২৮ আগস্ট থেকে। ওই দিন বিকেলে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী মার্কেট এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুল মান্নানকে (২৭)।
১ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়িতে নিয়ে মো. ইউসুফ মিয়া (৬৫) নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে খুন করে লাশ ফেলে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। ৬ আগষ্ট ওই বাগান বাড়িতে থাকা ২ শতাধিক গরু লুট করে নিয়ে যায় তারা।
১১ নভেম্বর নিখোঁজের তিনদিনের মাথায় রক্তাক্ত অবস্থায় হাফেজ মাওলানা আবু তাহের (৪৮) নামে এক মাদ্রাসাশিক্ষকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
গত ২৪ জানুয়ারি উপজেলার নোয়াপাড়া এলাকায় মোটরসাইকেলে করে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন মো. জাহাঙ্গীর আলম নামের এক খাতুনগঞ্জের শুঁটকি ব্যবসায়ী।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মুহাম্মদ হাসান (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে নোয়াপাড়ার ঘর থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা।
গত ১৫ মার্চ ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের পিটুনী ও ছুরিকাঘাতে খুন হন হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর সর্ত্তা গ্রামের কমর উদ্দিন জিতু (৩৬) নামে এক যুবদল কর্মী।
গত ২১ মার্চ পূর্বগুজরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বৃহত্তর হোয়ারাপাড়া এলাকার মোবারক খালের পূর্ব পাশে খোলা জমি থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মো. রুবেল (৩৫) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। গরু চোর সন্দেহে তাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
১৯ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে চট্টগ্রামের রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গরিব উল্লাহপাড়া গ্রামে ভাত খাওয়ার সময় গুলি ও ছুরিকাঘাত করে যুবদল কর্মী মানিক আবদুল্লাহকে (৩৬) হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
চার দিনের ব্যবধানে মো. ইব্রাহিম নামে আরও এক যুবদলকর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ২২ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে রাউজান সদর ইউপির পূর্ব রাউজান ৮ নম্বর ওয়ার্ডে গাজীপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ইব্রাহিম মোহাম্মদ আলমের ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন।
দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করে চলে যাওয়ার সময় কদলপুর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তালুকদার বাড়ির আবুল কালামের ঘরে ভাঙচুর চালায়। এ সময় তার ছেলে মান্নানকে না পেয়ে তার ভাই অটোরিকশাচালক মো. নাঈমের পায়ে এবং হাঁটুতে গুলি করে। তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
গত ৮ মাসে রাউজানে শতাধিক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটলেও মামলা হয়েছে ৩৪টি। ভয় ও হয়রানির কারণে থানায় মামলা করতে যায়নি অনেকে। তাছাড়া বিএনপি দুই গ্রুপের সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে তেমন আগ্রহী নয় থানা পুলিশ। ফলে সন্ত্রাসীদের আস্ফলন দিন দিন বেড়েই চলেছে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের রাউজানে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়সহ নানান অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গত বছরের ৫ নভেম্বর বিএনপি শোকজ করে।
শোকজ নোটিশে উল্লেখ করা হয়, এলাকায় দলমত নির্বিশেষে ধনী ব্যবসায়ীর তালিকা করে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়, ওমান বসবাসরত সিআইপি ব্যবসায়ী ইয়াসিনের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা চাঁদা দাবি, চাঁদা না পেয়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ইয়াসিনের রাউজানের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, সিআইপি ব্যবসায়ী মো. ফোরকানের কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে, না পেয়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ফোরকানকে নির্মম শারীরিক নির্যাতন, অনুগত সন্ত্রাসীরা দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থানরত রাউজানের ব্যবসায়ীদের ওপর ঢালাও চাঁদাবাজির মাধ্যমে এলাকায় আতঙ্কের জনপদে পরিণত করার অভিযোগ রয়েছে।
এই সব অভিযোগ অস্বীকার করে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘আমার সন্ত্রাসী বাহিনী নেই। মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য দিয়ে আমার সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করছেন গোলাম আকবর।’
অন্যদিকে গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন,‘রাউজানের মানুষ আর কোনো সন্ত্রাসের গডফাদারকে মেনে নেবে না। আর কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেবে না। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের জন্য গিয়াস কাদেরকে শোকজ করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।’
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে তৎপর বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খন্দকার। উভয়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসী ক্যাডারদের চাঁদাবাজি, খুন সন্ত্রাসের কারণে রাউজানের সাধারণ মানুষ অতিষ্ট। খুন, অপহরণ ও সন্ত্রাসের শিকার হতে পারেন—এমন শঙ্কায় ঈদের সময়ও অনেক ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী গ্রামের বাড়ি যায়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত ৮ মাসে বিএনপির দুই গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও চাঁদাবাজি এতটাই বেড়েছে যে,— সাধারণ মানুষ বলতে শুরু করেছে— আগেই ভালো ছিলাম!
বিএনএনিউজ/ বাবর