।। শামীমা চৌধুরী শাম্মী ।।
পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সংগ্রামী জনতা শাসকগোষ্ঠীর দমনপীড়ন ও সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান। সেই ঐতিহাসিক দিনে ১৯৮৮ সালে দেশীয় স্বৈরশাসককে উৎখাত করতেই চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট গণ সমাবেশের ডাক দেয়। কিন্ত তৎকালীন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ এই সমাবেশস্থল ও আশেপাশে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানের আশেপাশে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে মুখিয়ে ছিল সারাদেশ। তৎকালীন ১৫ দলীয় জোট নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার আগমণের প্রহর গুণছিল হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা। বেলা দেড়টার দিকে শেখ হাসিনার গাড়ি কোতোয়ালী থানা হয়ে পুরনো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন অতিক্রম করছিল।
এ সময় স্বৈরশাসকের পেটোয়া বাহিনী মুক্তিকামী জনতার গণজোয়ার দেখে ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাই এ সমাবেশ বানচাল করে দিতে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার রকিবুল হুদার নির্দেশে গর্জে ওঠে পুলিশ বাহিনীর রাইফেল। আওয়ামী লীগ ও ১৫ দলীয় নেতাকর্মীরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে নেত্রীকে বাঁচাতে মানবধর্ম রচনা করেন।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিত গুলিতে ঝরে পড়ে অন্তত ২৪টি তাজা প্রাণ। আহত হন তিন শতাধিক গণতন্ত্রকামী মানুষ। এখানেই শেষ নয় নৃশংসতার । একপর্যায়ে পুলিশের কড়া পাহারায় নিহতদের অনেকের লাশ ময়না তদন্ত না করেই রাতের আঁধারে নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
নিহতরা হলেন- হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবারট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও মো. শাহাদাত।
১৯৯০ সালে গণ আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় আসে বিএনপি। কিন্তু এরশাদের নিয়োগকৃত মির্জা রকিবুল হুদাকে বহাল রাখে বিএনপি।
১৯৯২ সালের ৫ মার্চ ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে প্রয়াত আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় হত্যাকাণ্ডের সময় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারের দায়িত্বে থাকা মির্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করা হয়। এতে রকিবুল হুদাকে ‘হত্যার নির্দেশদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে মামলাটি তদন্ত হয়নি। ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মির্জা রকিবুল হুদাকে পুলিশ কমিশনার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মামলাটি আলোর মুখ দেখে।
৩২ বছর ধরে বিচারকার্য চলাকালে মির্জা রকিবুল হুদাসহ মারা যান তিনজন। আলোচিত এ মামলার মোট সাক্ষী ১৬৭ জন। এর মধ্যে ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হয়। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি ঘটনার ৩২ বছর পূর্ণ হওয়ার মাত্র চারদিন আগে হওয়া আদালতের রায়ে পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তারা হলেন-মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, গোপাল চন্দ্র মণ্ডল (জেসি) ও আব্দুল্লাহ। এরা প্রত্যেকেই পুলিশের সাবেক সদস্য ছিলেন। একই রায়ে আদালত ৩২৬ ধারায় পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডও প্রদান করেন।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রধান ফটকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে নিহত ২৪ জনের নাম লিপিবদ্ধ করা আছে। এটি ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারির আগে এই স্মৃতিস্তম্ভটি ধুঁয়ে মুছে পরিস্কার করা হয়। সকালে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি, মহানগর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এই পর্যন্তই। সারা বছর স্মৃতিস্তম্ভটি পড়ে থাকে অযত্ন অবহেলায়।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি গণহত্যাকান্ডের পর শহীদ পরিবারদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সান্তনা দেওয়া হয়েছিল। দল ক্ষমতায় এলে উপযুক্ত বিচার হবে, শহীদ পরিবারগুলো পাবে যথাযথ সম্মান ও ক্ষতিপূরণ। ৩২ বছর পর বিচার হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম হত্যাকান্ডের ৩৬ বছর পরও শহীদ পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া দূরে থাক, খোঁজখবরও রাখেনি। অথচ চট্টগ্রাম গণহত্যার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পঞ্চমবার সরকার গঠন করেছে। চট্টগ্রাম গণহত্যার শহীদ পরিবারগুলোর জন্য প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠেছে সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের সেই কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’।
বিএনএ/এইচ.এম /এইচমুন্নী/ হাসনা