।। শামীমা চৌধুরী শাম্মী ।।
বিএনএ, ঢাকা: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সামনে আসার পরই পালটে গেছে দৃশ্যপট। ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগ এই হত্যাকান্ডকে নিয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। হত্যার পেছনে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের বাঘাবাঘা নেতাদের নাম বেরিয়ে আসা শুরু করলে নানামুখী তদবিরের চাপ বাড়ে। ফলে তদন্তে সতর্ক অবস্থান নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
আনার হত্যায় সরাসরি জড়িত তিন আসামির আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক নেতার নাম চলে আসে। এর পরই গ্রেপ্তার হয় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু এবং ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু। নজরদারিতে আছেন আরও কয়েক নেতা।
গ্রেপ্তার বাবু সাতদিনের রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে মিন্টুকে আট দিনের রিমান্ডে নিলেও তিন দিনের মাথায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও মিন্টু অস্বীকার করেছেন। এছাড়া তিনি আদালতে কোনো জবানবন্দিও দেননি। রিমান্ডের সময় পূর্ণ না করার পেছনে কোনো প্রভাব কাজ করেছে কিনা বা এমপি খুনের সঙ্গে জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মিন্টুকে গ্রেপ্তারের পর আনার হত্যায় তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ১৩ জুন বিকালে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে বিস্তারিত তুলে ধরেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। কিন্তু এরপরই পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট।
জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মিন্টু ও বাবুকে গ্রেপ্তারের পর তাদের ঘনিষ্ঠ অনেক প্রভাবশালী নেতা তদবির শুরু করেন। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেন, গ্রেপ্তাররা দলের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতা। তবে শুরু থেকেই আনার হত্যার তদন্তে এক পাও পিছু হটেনি ডিবি, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে এমন দাবি ডিবির তদন্ত কর্মকর্তার।
অভিযোগ আছে, মিন্টু গ্রেপ্তার হতে পারেন এমনটা বোঝার পরই ঝিনাইদহ থেকে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেক নেতার কাছে ধরনা দিয়েছেন। মিন্টুর পক্ষে অবস্থানও নেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একাধিক নেতা। ফলে গ্রেপ্তারের পর মিন্টুর রিমান্ড পূর্ণ না করার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন এমপি আনারের ঘনিষ্ঠরা।
তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি, মিন্টুর কাছে যে বিষয় জানার ছিল তা জানতে পারায় তাকে আর রিমান্ডে রাখার প্রয়োজন হয়নি। পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে ফের তাকে রিমান্ডে আনা হবে।
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছেন মামলার তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে এক মানববন্ধনে অভিযোগ করেন প্রভাব খাটিয়ে মূল খুনিদের আড়াল করারও চেষ্টা চলছে। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছেও বিষয়টি তুলে ধরেন। অভিযোগ করেন তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবির এক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি)র বিরুদ্ধেও। বদলির আদেশের পরও ওই এডিসি ডিবিতে থেকে আসামিদের পক্ষে প্রভাব খাটাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল ডরিনের। এর পরই ওই এডিসি বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান করেন।
এদিকে আনার হত্যায় গ্রেপ্তারের পরও জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহালতবিয়তে আছেন মিন্টু ও বাবু। প্রভাবশালী এই দুই নেতার পদই শুধু বহাল নয়, তাদের পক্ষে আন্দোলন কর্মসূচিতেও নেমেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। মিন্টুর অনুসারীরা তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন, মিছিলসহ লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ আনার জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য হলেও তার মৃত্যুতে শোকও প্রকাশ করা হয়নি কমিটির পক্ষ থেকে।
আনার হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ এই দুই আসামি ক্ষমতাসীন দলের জেলা কমিটির পদে বহাল থাকায় মামলার তদন্ত কার্যক্রম প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।
আনার হত্যার আঙ্গুল এখন সাইদুল করিম মিন্টুর দিকে। তিনি ২০১৪ সাল থেকে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এর আগে ছিলেন শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরও নেতা ছিলেন তিনি। জেলা ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিও তার নিজের মতো করে সাজানো। মিন্টুর পক্ষের নেতারাই তার মুক্তির দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আনারের ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ ‘জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমপি আনারের জন্য একটি শোকসভা কিংবা এই হত্যাকান্ডের বিষয়ে কোন বক্তব্য দেননি।
সংসদ সদস্য আনার হত্যায় শোক প্রকাশ না করার বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ-সদস্য শফিকুল ইসলাম অপু বলেন, ‘যেহেতু ডিএনএ নমুনা এখনো মেলানো হয়নি, সেহেতু এমপি আনারের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে শোক প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। তার মৃত্যুর বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হলে শোকপ্রস্তাবসহ কর্মসূচি পালন করবেন বলে জানান তিনি।
মিন্টুর পক্ষে আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, এই আন্দোলনের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। মিন্টুর ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা আন্দোলন করছে।
উল্লেখ্য, এমপি আনার ১২ মে ভারতে যান। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে ডরিন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে একটি হত্যা মামলা হয়। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
বিএনএনিউজ/ বিএম