বিএনএ,চট্টগ্রাম: পেশায় তারা পুরোদস্তুর চোর। তবে রমজান মাসে চুরি করেন না এ চক্রের সদস্যরা। গত সাত বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ-জামালখান, আন্দরকিল্লা, চকবাজারসহ বাণিজ্যিক এলাকায় বেছে বেছে অফিসগুলোতে চুরি করতো সংঘবদ্ধ এই চোরচক্রটি।প্রতিদিন ঘড়ির কাটা রাত সাড়ে ১১টায় পৌঁছালে একটি সিএনজি অটোরিকশা চষে বেড়ায় তারা। ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানের জানালার গ্রিল মাত্র এক মিনিটে ভেঙে লুটে নেন নগদ টাকা, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ঘিয়ের কৌটা, দুধের প্যাকেটসহ যা হাতের কাছে পান তাই! আর বাড়িতে পৌঁছে সেই চোরাই মালামাল নিরাপদে রাখতে জমা দিতেন স্ত্রীর হাতে। এভাবে প্রায় ৩শ চুরি সফলভাবে সম্পন্ন করেছে চক্রটি।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ মে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের নগরীর জুবলী রোড শাখার অফিসে গ্রিল কেটে চুরির চেষ্টা এবং একই বিল্ডিংয়ের বাংলাদেশ সাপ্লাইয়ার্সের ৪র্থ তলার অফিসের গ্রিল কেটে ও লকার ভেঙে চুরি হয় সাড়ে ২৭ লাখ টাকা। আর এ ঘটনার তদন্তে নেমে সন্ধান মেলে এ দুর্ধর্ষ চোর চক্রের। এ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
শনিবার (২২ মে) ভোরে চটগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানার বিশ্বকলোনি এবং পুরাতন রেলস্টেশন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের ব্যবহৃত সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও নগদ ২৭ লাখ ৫ হাজার টাকাও উদ্ধার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার তিনজন হলেন— চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ থানার বিশ্বকলোনী কাঁচাবাজার এলাকার মো. মনির হোসেন (৪০), চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানার লালখান বাজার এলাকার মো. মাহফুজ (৩০), চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ থানার বিশ্বকলোনী কাঁচাবাজার এলাকার খুকু মনি ওরফে খুকু বেগম (২৮)।
এদের মধ্যে চুরির মূল হোতা মনির পুলিশের কাছে ‘ভিআইপি চোর’ হিসেবে পরিচিত। পুলিশ জানিয়েছে, সাধারণত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই চুরি করে মনির। কোনো বাসাবাড়িতে চুরি করে না। বড় অংকের টাকা যেখানে থাকে সেই প্রতিষ্ঠানকেই টার্গেট করে সে। আর মাহফুজ অটোরিকশা চালক এবং খুকু মনি সে মনিরের স্ত্রী।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ১৮ মে জুবিলী রোডের বাংলাদেশ সাপ্লাইয়ার্স নামক প্রতিষ্ঠানের মালিক কাইজার আবুওয়ালা প্রতিদিনের সন্ধ্যায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিসের দরজা তালাবন্ধ করে বাসায় চলে যান। পরদিন একই ভবনের তৃতীয় তলায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে জানালার গ্রীল কেটে ভিতরে চুরির সংবাদ পেয়ে সকাল ১১টায় অফিসে গিয়ে দেখেন, অফিসের ২টি জানালার গ্রীল কাটা এবং অফিস কক্ষের ভেতরে রাখা লোহার সিন্দুক ও আলমারির ড্রয়ার খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। লোহার সিন্দুকের ড্রয়ারের ভিতর যাবতীয় মূল্যবান জিনিসপত্রসহ কাগজপত্র মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো এবং নগদ প্রায় সাড়ে ২৭ লাখ টাকা নেই। এ ঘটনায় তিনি ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে এজাহার দায়ের করলে লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ২টি পৃথক মামলা রুজু হয়।
উপ-পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক জানান, গত ১৯ মে নগরীর জুবিলি রোডে বাংলাদেশ সাপ্লাইয়ার্স নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে চুরির চেষ্টার অভিযোগে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের হয়। আমাফা সেন্টার নামে একটি ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠান দুটিতে সংঘটিত অপরাধের ঘটনা তদন্তে নামে পুলিশ। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের পর দেখা যায়, আগেরদিন ১৮ মে সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে পরদিন ভোরের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। এরপর ফুটেজ দেখে প্রথমে অটোরিকশা চালক মাহফুজকে শনাক্ত করা হয়। তাকে রেলস্টেশন এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে মনিরের তথ্য পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, চুরির সময় সিসিটিভি ক্যামেরা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সব রকম কৌশল অবলম্বন করতো এ চক্রটি। গ্রিল কেটে অফিসে প্রবেশের পর সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলে ডিভিআর মেশিন খুলে বালতির পানিতে চুবিয়ে রাখতো। তবে গত ১৮ মে বাংলাদেশ সাপ্লাইয়ার্সের অফিসে ডিভিআর মেশিন ভেবে ডিশ কানেকশন মেশিন পানিতে চুবিয়ে রাখে। কিন্তু ওই অফিসটির ডিভিআর মেশিন অন্য জায়গায় থাকার কারণে মনিরকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার মনির হোসেন একজন পেশাদার চোর। দীর্ঘ ৭ বছর ধরে তিনি চুরির পেশায় জড়িত। এর পাশাপাশি নগরের বিশ্বকলোনী শাপলা গ্যাস লাইন এলাকায় তার একটি ভাঙ্গারির দোকান আছে। চোরাই মালামাল ওই ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি হতো। তাছাড়া আন্তঃজেলা চোর আমির তার আপন বড় ভাই। অন্যদিকে এ চক্রের সদস্য মাহফুজ ছিলেন সিএনজি অটোরিক্সা চালানোর দায়িত্বে। চুরিতে ধরা পড়ে গেলে ভয়ভীতি দেখিয়ে বাঁচার জন্য সিএনজিতে দু’টি চাপাতি রেখেছিলেন তারা। মূলত ড্রাইভার মাহফুজ দিনে ঘুমাতেন আর রাতে বের হতেন চুরির কাজে। এই দুর্ধর্ষ চোর চক্রের সবচেয়ে সহজ কাজের দায়িত্বে ছিলেন মনিরের স্ত্রী খুকু মনি। চোরাই হওয়া মালামাল আর নগদ টাকা নিজের বাসায় লুকিয়ে রাখতেন তিনি।
দীর্ঘ ৭ বছরে ২৫০ থেকে ৩০০টি চুরির কথা স্বীকার করেছেন মনির। সম্প্রতি তার চুরির তালিকায় রয়েছে— কোতোয়ালী থানার নজীর আহমদ রোডের একটি বেসরকারি অফিস থেকে ২০ হাজার টাকা চুরি, জামালখান এলাকার একটি কম্পিউটার একাডেমি থেকে ল্যাপটপ চুরি, রাজাপুকুর লাইনের ৩টি কাগজের গোডাউন থেকে ৫০ হাজার টাকা, চকবাজারের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে ৩৬ হাজার টাকা, ১টি এলইডি মনিটর, ১২ কেজি দুধের প্যাকেট, ১৩ প্যাকেট ঘি, আগ্রাবাদের একটি অফিস থেকে মূল্যবান জিনিস চুরিসহ অসংখ্য চুরির ঘটনা।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন জানান, শুক্রবার রাত ১১টার দিকে রেলস্টেশন এলাকা থেকে অটোরিকশাচালক মাহফুজকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর মাহফুজের দেয়া ঠিকানায় আকবরশাহ থানা এলাকা থেকে মনির ও তার স্ত্রী খুকি বেগমকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে- খুকি বেগমের কাছে থাকা চুরির ২৭ লাখ টাকা ও মাহফুজের কাছে থাকা পাঁচ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, মনির একজন পেশাদার চোর। সে ইতোমধ্যে ৩০০টির মতো চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। তার বিরুদ্ধে নগরের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
বিএনএনিউজ/মনির