।।ইয়াসীন হীরা।।
২০ এপ্রিল ২০২২। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকার ‘দি ভিলেজ’ রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) আয়োজিত ‘সমুদ্র অর্থনীতি: বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে ‘সমুদ্র সম্পদ মন্ত্রণালয়’ গঠনের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি আন্তর্জাতিক ভূ-অর্থনীতি বিশ্লেষক, একুশেপদক প্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম।
বাংলাদেশের আগামী দিনের অর্থনীতির বড় ক্ষেত্র সমুদ্র সম্পদ। এ সমুদ্র সম্পদ আহরণ, সংরক্ষণ ও রপ্তানি সংক্রান্ত দিকনির্দেশনামূলক এমন একটি জাতীয় সেমিনারে সঞ্চালনা করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সমুদ্র সম্পদ আহরণের মাধ্যমে জিডিপিকে দুই অঙ্কে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবনা ও সুপারিশ সংক্রান্ত এ সেমিনারের মুল প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) এর সম্পাদক মিজানুর রহমান মজুমদার। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আকতার।
প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদেশের অর্থনীতির আইকনখ্যাত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়, মজুদ সম্পদ, এর ব্যবহার আহরণ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। প্রশ্ন তুলেন নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা নিয়ে। উপস্থিত সাংবাদিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক এলিটসহ প্রায় তিনশত শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সমুদ্র সম্পদ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম এর বক্তব্য শুনেন।
ড. মইনুল ইসলাম এর প্রতিটি কথায় ছিল যুক্তি ও তথ্য। উচ্চারণে দেখান সাহসিকতা। এমন কিছু কথা বলেছেন, যা অপ্রিয় হলেও সত্য। ক্ষোভ প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও মেধাবি সাবেক এই অধ্যাপক বললেন, কখনো রাজনৈতিক, কখনো আমলাতান্ত্রিক কখনো বা বিদেশি শক্তির চাপে প্রায় আরেকটি বাংলাদেশ সমান! (১ লক্ষ ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার) সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশ অধিকার সুরক্ষা, তেল গ্যাস উত্তোলন করতে পারছে না।
তিনি বলেন, ২০১২ সাল থেকে ২০২২ সাল। এই ১০ বছরে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে পাওয়া সমুদ্র সীমায় তেল গ্যাস উত্তোলন দূরে থাক অনুন্ধান কার্যক্রমও চালাতে পারেনি বাংলাদেশ। মাত্র ৭০ কিলোমিটারের মধ্যেই বাংলাদেশ মৎস্য আহরণ করে। অবশিষ্ট প্রায় সাড়ে ৬০০ কিলোমিটার এলাকায় কেউ যায়নি, চেষ্টাও করেনি!
একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সেমিনারে মুল প্রবন্ধের প্রতিটি বক্তব্যকে সমর্থন করে আরও বলেন, কাগজে কলমে সমুদ্র বিজয় করলে হবে না, সেখানে দখল বজায় রেখে দ্রুত আহরণ করতে হবে মজুদকৃত তেল, গ্যাস। কারণ, তেল-গ্যাস সীমানা মানে না! প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমার ও ভারত তাদের এলাকা থেকে তেল গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে অনেক আগে থেকে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ তার সম্পদ উত্তোলন না করলে এক সময় বাংলাদেশ অংশের তেল গ্যাস ভান্ডারও শেষ হয়ে যাবে।
ড. মইনুল ইসলাম জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে শামিল করার লক্ষে দ্রুত সমুদ্র সম্পদ আহরণের জন্য পৃথক ‘ সমুদ্র সম্পদ মন্ত্রণালয়’ গঠনের দাবি জানান। উপস্থিত সবাই করতালি দিয়ে তার দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।একজন সংবাদকর্মী ও রাজনৈতিক গবেষক হিসাবে আমি ফিরে গেলাম আরও ১০০ বছর আগে। মনে পড়ে গেল মহাত্ম গান্ধীর কথা।
১৯২১ সাল। বৃট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে মহাত্ম গান্ধী ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলন’ এর ডাক দিলেন। সেই আন্দোলনে প্রথম সাড়া দিয়েছে চট্টগ্রাম! চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান চট্টগ্রাম কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপ্যাল নৃপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ( যার নামে জেএমসেন হল) নেতৃত্বে চট্টগ্রামবাসী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল-মিটিং করেন। স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন হাজার হাজার যুবক। পথে পথে বিলাতি কাপড় পুড়িয়ে দেশি কাপড় পড়ার জন্য জনসচেতনতা তৈরি করেন।
চট্টগ্রামে অহিংস অহযোগ আন্দোলনের এমন শক্তি ও ব্যাপ্তি দেখে ভারতের বেলগাঁও থেকে মারাঠি ভাষায় প্রকাশিত এবং ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাবুরাও ঠাকুর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘তরুণ ভারত’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘ চট্টগ্রাম সবার আগে’।
শুধু কী অসহযোগ আন্দোলনে ?
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্য সেন চট্টগ্রাম অস্ত্রগার লুন্ঠনের নেতৃত্ব দেন। তার ধরাবাহিকতায় ১৯৩১ সালো ২৪ সেপ্টেম্বর বীর কন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রাম থেকে বৃট্রিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম এর নেতৃত্ব দেয়। হামলা করা হয় তখনকার ইউরোপিয়ান ক্লাবে।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন চট্টগ্রাম ছিল সক্রিয় ও প্রতিবাদে মুখর। তমদ্দুন মজলিসের চট্টগ্রাম শাখার নেতৃত্ব দেন সোলায়মান খান, এজাহারুল হক, সাদেক নবী, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী (মন্টু), চৌধুরী শাহাবুদ্দীন আহমদ খালেদ, মাহফুজুল হক, মো. ইব্রাহীম, তফাজ্জল আলী, শাহ ওবায়দুর রহমান, মকসুদুর রহমান, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলায়মান এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমূখ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের আন্দোলনে যুক্ত হন তফাজ্জল আলী, ডা. মুহাম্মদ আলী, আহমদ ফরিদ (সাবেক রাষ্ট্রদূত), হাসান ইকবাল, সাদেক নবী, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী (মন্টু), সাংবাদিক সৈয়দ মোস্তফা জামাল, আহমদ ছগীর, মোহাম্মদ নুরুল্লাহ, হাবীবুর রহমান, মাওলানা হাসান শরীফ, আবদুর সাত্তার চৌধুরী।
১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুন্থানে চট্টগ্রাম ছিল সবার আগে। তারই ধরাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ঘোষণা আগে ২৩ ও ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে আসা অস্ত্র-গোলাবারুদ চট্টগ্রামের মানুষ রাস্তায় শুয়ে তা খালাস করতে বাধা দেয়। আর স্বাধীনতার ঘোষণা তো চট্টগ্রাম থেকেই আসে।
স্বৈরাচার বিরোধী গণতন্ত্রের সংগ্রামে চট্টগ্রাম সবার আগে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে ২৪ জন শহীদ হন। তারই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের গণ অভ্যুন্থান এবং ১৯৯১ সালে তিন জোটের রূপরেখায় দেশে ফিরে আসে সংসদীয় গণতন্ত্র!
চট্টগ্রামে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) আয়োজিত ‘ সমুদ্র অর্থনীতি: বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এ সেমিনার থেকে পৃথক ‘সমুদ্র সম্পদ মন্ত্রণালয়’ গঠনের ড. মইনুল ইসলাম স্যারের এমন দাবি মনে করিয়ে দিল, আন্দোলন সংগ্রামে চট্টগ্রাম সবসময় ‘প্রথম এবং আগে’!
বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় মহান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত তেল, গ্যাসসহ সব ধরনের প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য পৃথক ‘সমুদ্র সম্পদ মন্ত্রণালয়’ গঠনের দাবি কোনো ব্যক্তি বা অঞ্চলের দাবি নয়। এটি এখন সময়ের জাতীয় দাবি বলে আমার অভিমত।
দেশের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক, ড. মইনুল ইসলাম স্যারের এ দাবি বাস্তবায়নে আমি বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) সম্পাদক মিজানুর রহমান মজুমদারসহ আপনাদের সঙ্গে এগিয়ে নিতে চাই।
আসুন, ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক মতার্দশ ভুলে দেশ ও জাতির অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নার্থে ‘সমুদ্র সম্পদ মন্ত্রণালয়’ গঠনের দাবিকে জোরদার করি।
আপনার একটি লাইক,কমেন্ট, শেয়ার সরকারের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে সহায়তা করবে।
লেখক ; নির্বাহী সম্পাদক , বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি