বিএনএ, ঢাকা : ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স নবাব অ্যান্ড কোম্পানির মালিকের নাম নবাব খান। এক মামলায় নবাব পরিচয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে আসেন তার কর্মচারি। আদালতে বিষয়টি ধরা পড়ে। আদালত নবাব পরিচয় দেয়া ফাহিম আহম্মেদকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার হাকিম আদালতে ঘটনাটি ঘটেছে। নবাব খানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের নাজির মো. রেজোয়ান খন্দকার জানান, এ প্রতারণার ঘটনায় আরেকটি মামলা করা হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, শুনানির সময় আদালতে আত্মসমর্পণের জন্য উপস্থিত মামলার আসামিকে নিয়ে সন্দেহ হলে মুখ্য মহানগর হাকিম রেজাউল করিম চৌধুরী তার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করেন। এসময় নিজের পরিচয় দিতে না পারায় বিচারক পরিচয়পত্র দেখাতে বলেন। সেটাও দেখাতে ব্যর্থ হন ওই ব্যক্তি।
পরে আদালত তাকে ‘ভুয়া’ নবাব খান হিসেবে শনাক্ত করেন এবং আদালত সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে যাচাই করার নির্দেশ দেন। পরে ‘ভুয়া নবাব খান’ হিসেবে ফাহিমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়।
নবাব পরিচয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করা ফাহিম চট্টগ্রামের কর্ণফুলি থানার উত্তর বন্দর গ্রামের বাসিন্দা। তার পিতার নাম ফিরোজ আহম্মেদ। ফাহিম নবাব খানের ছোটবোনের ছেলে। সর্ম্পকে মামা-ভাগিনা।
ফাহিম মামা নবাব খানের প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী কর্মচারি। সব কিছু জেনে শুনে ফাহিম মামা নবাব খান সেজে আদালতে আত্মসর্মাপন করতে যান। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় বিচারকের সন্দেহ হয়। তিনি জাতীয়পরিচয়পত্র দেখতে চান। কিন্তু তা দেখাতে পারেননি ফাহিম।
মামলা সুত্রে জানা গেছে, মেসার্স নবাব অ্যান্ড কোম্পানির সত্ত্বাধিকারী নবাব খান বিসিআইসির গুদামে ইউরিয়া সার সরবরাহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে তা রক্ষা করেননি। এতে কৃষকরা ইউরিয়া সারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এর আগে বিসিআইসির গুদামে ইউরিয়া সার পৌঁছানোর জন্য আসামি নবাব খানকে বারবার বলা হলেও সে গুদামে সার সরবরাহ না করে প্রতারণার মাধ্যমে ৬১৯ কোটি ৯৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪১৯ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এর উপ-মহাব্যবস্থাপক সাইফুল আলম বাদী হয়ে ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর মামলাটি দায়ের করেন।
অভিযুক্ত নবাব খানের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার ১ নম্বর বৈরাগ ইউনিয়েনর উত্তর বন্দর গ্রামে। তার পিতার নাম তরমিয়ত খান। ৪ভাইয়ের মধ্যে নবাব খান দ্বিতীয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ইংরেজি ও হিন্দি জানেন।
পৈত্রিকভাবে তেমন কোন সহায় সম্পদ ছিল না তার বাবার। সম্বলের মধ্যে বাড়ির পাশে একটি চা দোকান ছিল পিতা তরমিয়ত খানের। ৪ ভাই মিলে চা দোকানটি চালাতেন। সেই চা দোকানের ‘টিবয়’ ছিল নবাব খান। বড় ভাই রহিম খান, ছোট ভাই ফেরদৌস খান, রশিদ খানও কাজ করতেন।
জানা যায়, নবাব খান বিয়ে করেন তারই জেঠাতো বোন রায়না বেগমকে। সেখানে একটি সন্তানও জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু জম্মের পর মারা যায়। অভাবের তাড়নায় এক সময় রায়না বেগম নবাব খানকে তালাক দিয়ে চলে যান।
পরবর্তীতে নবাব খান র্স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় চাকুরিরত হাবিবা খানম প্রকাশ পপিকে বিয়ে করেন। তিনি এখন লন্ডনে থাকেন। তাদের তিন সন্তানও সেখানে লেখাপড়া করে।
উল্লেখ, আশির দশকে গহিরা, রায়পুর ছিল সমুদ্র পথে চোরাচালানের অন্যতম ঘাটি। জাহাজে জাহাজে বেনসন , ৫৫৫ সিগারেট, মদ , সোনা এবং বিভিন্ন ধরনের ইলোক্টানিক্স সামগ্রী আসতো। নবাব খান অবৈধভাবে আসা সিগারেটের ক্যারিয়ার ছিলেন। তাদের চোরাচালানের গডফাদার ছিল খাতুনগঞ্চের অবাঙ্গালী ব্যবসায়ি সুশীল রাজগরিয়া।
চোরাচালানের জন্য নবাব খানের বাড়ির এলাকাটি এতটাই নিরাপদ ছিল যে, বিএনপি জামায়াত জোট ২০০৪ সালের ১লা এপ্রিল মধ্যরাতে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাস করা হয়।
১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর সামরিক আইন জারি করে। তখন চোরাচালান অভিযানে গ্রেফতার হন নবাব খান ও সুশীল রাজগরিয়া। সে সময় তারা প্রায় ৬ মাস জেলে ছিলেন।
১৯৮৪ সালে চিটাগাং ইউরিয়া ফাটিলাইজার ফ্যাক্টরি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন প্রধান নিরাপত্তা রক্ষী হিসাবে নিয়োগ পান নবাব খান। পরবর্তীতে নিরাপত্তা রক্ষী ও শ্রমিক সরবরাহ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সরবরাহের কাজও পান।তখন প্রতিষ্ঠানটির মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান ছিলেন জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক আমিনুল হক। তার সঙ্গে সখ্যতা ছিল নবাব খানের। এছাড়া জাপানি ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে খুবই আস্থাবাজন ছিলেন নবাব খান। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপিকে পৃষ্টপোষকতা করেন নবাব খান। বিএনপির স্থানীয় সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজামের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর পৃষ্ঠপোষকতা পায় নবাব খান। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী লিমিটেড ( সিএফএল), কর্ণফুলী ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী লিমিটেড (কাফকো) এবং ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানী লিঃ এর পুরো নিয়ন্ত্রণে নেন। বিসিআইসি’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সারের পরিবহণসহ নানা টেন্ডার ছিল তার নিয়ন্ত্রণে।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসলেও তার প্রভাব বজায় ছিল রাঙ্গাদিয়ার তিনটি সার কারখানায়। জোট সরকারের আমলে লাখ লাখ টন সার মায়ানমারে পাচার করেন নবাব খান।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসার পর তার নিয়ন্ত্রণ ও বলয়ের বাইরে চলে যায় সারকারখানা সমূহ । আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী তৎপরতা অপরাধে প্রায় বছর খানেক জেলে ছিলেন নবাব খান।
প্রতিষ্ঠা করেন স্টিভিডার কোম্পানি নবাব এন্ড কোম্পানি, শেয়ার সিকিউরিটি নবাব সিকিউরিটি কোম্পানি, ইত্যাদি শপিং কমপ্লেক্স, এনসি ১, এনসি ২ লাইটারেজ জাহাজসহ বেশ কয়েকটি সমুদ্রগামি জাহাজ।
প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল প্লাজার পিছনে ১১ গন্ডার প্লট, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় অন্তত: ৫০ থেকে ৬০ বিঘা জমি, সীতাকুন্ড উপজেলার বারআউলিয়া এলাকায় ১৬ বিঘা জমি, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় ৭ তলা বাড়ি, নাসিরাবাদে ফ্ল্যাট, ঢাকায় ফ্ল্যাট এর খোঁজ পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে তার স্বনামে বেনামে বিভিন্ন সম্পদ রয়েছে।
সূত্র জানায়, বিসিআইসি’র আমদানি করা সার নবাব খান বিক্রি করে দিয়েছেন। সারের বড়ো অংশ মায়ানমারে পাচার করেছেন নবাব খান। আর সার বিক্রির টাকাও দেশে নেই। এ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
নবাব খানের পরিচালিত নবাব এন্ড কোম্পানির অফিস চট্টগ্রামের শেখ মুজিব রোডের বাদামতলী মাজারগেট এলাকায়। ঘটনার পর থেকে নবাব খান পলাতক রয়েছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন বলে সূত্রে প্রকাশ।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম।
Total Viewed and Shared : 198