১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য কোন দলই সংখ্যাগরিষ্টতা পায়নি। বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৮৮, জাতীয় পার্টি ৩৫, এবং জামায়াত ইসলামী ১৮ আসনে বিজয়ী হয়। এই অবস্থায় বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয় জামায়াত ইসলামী। সেই থেকে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী পরস্পরের হাত ধরে পথ চলা শুরু। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত আসন ভাগাভাগি করে। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়ে পরবর্তীতে সরকার গঠন করে উভয় দল।

২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী সমঝোতার মাধ্যমে অংশ নেয়। এতে উভয় দলের ভরাডুবি হয়। সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তারপর বিএনপি জামায়াত ২০ দলীয় জোট গঠন করে রাজপথে আন্দোলন করে। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে জামায়াত, বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে ব্যবহার করে রাতেই ভোটে বাক্স ভরে রাখে। বিএনপি ও জামায়াত ওই নির্বাচন প্রত্যাখান করে। এরপর থেকে রাজপথে থেকেছে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী। কিন্তু ২০২২ সালে দল দুটির সম্পর্ক শিথিল হয় ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
জুলাই–আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর গত সাড়ে পাঁচ মাসে বেশ কিছু বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে ‘দখল’ ও ‘চাঁদাবাজির’ অভিযোগ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতকে প্রথম বিতর্কে জড়াতে দেখা যায়, যা এখন বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল বা সংশোধনের বিতর্ক পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। গত কয়েক মাসে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দল দুটির সম্পর্কের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকা আড়াল করার চেষ্টা যে সহজ হবে না, তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। খোদ বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারাই একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা সামনে এনেছেন। তাঁরা জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী ‘রাজাকার’ বলে সমালোচনাও করেছেন। জামায়াত আমির এক বক্তব্যে বলেছেন, দেশে দুটি পরীক্ষিত দেশ প্রেমিক আছে। একটি জামায়াত ইসলামী অন্যটি সেনাবাহিনী। গত ৯ই জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় হাফিজ উদ্দিন আহমেদ জামায়াত আমিরের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
জামায়াত ইসলামী ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিল বা আমুল পরিবর্তন চায়। বিএনপি সংশোধন চাইলেও বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল চায় না।
একইভাবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগ’ পত্র রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে নেই এমন বক্তব্য সামনে আসার পর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের চেষ্টায় বিএনপি সায় দেয়নি। অন্যদিকে জামায়াত ভেতরে-ভেতরে রাষ্ট্রপতিকে সরানোর তৎপরতায় সমর্থন দিয়েছিল।
এ ছাড়া বিএনপি নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সংস্কারগুলো সেরে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু জামায়াত সরকারকে অনির্ধারিত সময় দিতে চায়।
বিএনপি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের বিপক্ষে। জামায়াত এর পক্ষে। বিএনপি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার বিপক্ষে। জামায়াত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ চায়।
ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৭ বছর করা সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে বিএনপি। এটি নির্বাচন প্রলম্বিত করার কৌশল মনে করছে দলটি। কিন্তু জামায়াত তরুণদের ভোটার করার যুক্তি দেখিয়ে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর করার ভাবনা সমর্থন করছে।
বিচারের আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভোটে অংশ গ্রহণের বিপক্ষে জামায়াত। কিন্তু বিএনপির নীতিনির্ধারকরা চায় নির্বাচনে থাকুক আওয়ামী লীগ।
জাতীয় নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে বিএনপির খুব একটা ‘সুসম্পর্ক’ নেই। সে তুলনায় জামায়াতসহ ইসলামপন্থীদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের সদ্ভাব দৃশ্যমান।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বড় একটি অংশ পালিয়েছেন, অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা নির্বাচন পর্যন্ত থাকলে ভোটের মাঠে তার একটা ‘সুবিধা’ পাওয়ার আশা করছে জামায়াত। সেটি হচ্ছে সংসদে বেশিসংখ্যক আসন পাওয়া।
নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিরোধ কেন—এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে। কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, জামায়াতকে এড়িয়ে চলার কৌশল নেয় বিএনপি। এর অন্যতম কারণ প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন।
বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াত পরস্পর বিরোধপূর্ণ অবস্থানে এসে ঠেকেছে। ৩৩ বছরের রাজনৈতিক মিত্র ও নির্বাচনী সঙ্গী দুটি দল—বিএনপি ও জামায়াতের সেই সম্পর্ক এখন অতীত। গীতিকার: বঙ্কিম ঘোষ ও সুরকার: মান্না দের গানের অনুকরণে বলতে হয় এই কূলে বিএনপি আর ঐ কূলে জামায়াত, মাঝখানে আওয়ামী লীগ ঐ বয়ে চলে যায়।
শামীমা চৌধুরী শাম্মী