২০০১ সালে অস্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি- জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার গঠন করেছিল। ওই সময়ে সারাদেশে জামায়াত ইসলামী ও ছাত্র সংগঠনের রমরমা রাজনৈতিক উত্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্ত ওই রমরমা সময়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জামায়াত ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্রশিবিরকে দেখা যায়নি। তবে জোট সরকারের শেষের বছর সর্বশেষ ২০০৬ সালে ক্যাম্পাসে মিছিল-সমাবেশ করেছিল ইসলামী ছাত্র শিবির। দীর্ঘ ১৭ বছর তাদেরকে ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসলে পুরোপুরি কোনঠাসা হয়ে পড়ে সংগঠনটি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্য শক্তি ইসলামী ছাত্র শিবির হলেও সংগঠনটি কৌশলগত কারণে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিল । কিন্তু ১১২ দিন পর ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার আগের দিন ১০টি ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে মতবিনিময় সভায় ডাকা হয়নি আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। দুই পর্বে অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় সভার প্রথম পর্বে চমক ছিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের অংশগ্রহণ। শুধু তাই নয়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সাদিক কায়েম নতুন পরিচয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি হিসাবে প্রকাশ্যে এসেছেন ।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতিসহ সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে—এমন আলোচনা সামনে আসার পর আজ ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খানের কার্যালয়ে দুই সহ–উপাচার্য মামুন আহমেদ ও সায়মা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় অংশ নেয় ইসলামী ছাত্রশিবির, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ও বিপ্লবী ছাত্র–যুব আন্দোলন , মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট , বাসদের সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্র শিবির সভাপতি সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমরা সব ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করতে বলেছি, যেখানে শুধু ফ্যাসিবাদের দোসর ছাড়া সব ছাত্রসংগঠন আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন খুব দ্রুতই সংলাপ আয়োজন করার কথা বলেছে। সেই সংলাপ এবং শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার আলোকে তাঁরা একটা সিদ্ধান্তে আসবেন।’
সাদিক আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগ ও ১৪ দলভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠন ফ্যাসিবাদের দোসর। তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। তারা বাদে বাকি সব সংগঠনের কনসেনসাসের ভিত্তিতে আমরা সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি করতে চাই।’
এ দিকে ছাত্রশিবিরকে সভায় ডাকা নিয়ে এবং ১৯৯০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের চুক্তি বাতিল হয়ে গেল কি না, সে বিষয়ে সভায় প্রশ্ন তোলেন ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ। তবে উপাচার্য এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি বলে জানান তিনি।
ছাত্র শিবিরসহ ধর্মীয় সংগঠনকে মতবিনিময় সভায় ডাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাসদ সমর্থিত ছাত্র সংগঠন সামাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা সোহাইল আহমেদও।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সাদিক কায়েম তার টাইমলাইনে দীর্ঘ স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন, ‘ফ্যাসিস্ট শোষণ শুধু ছাত্র রাজনীতি নয়, রাজনীতির সংজ্ঞাই পালটে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদে কোনো রাজনীতি থাকে না। বিরাজনীতি ফ্যাসিবাদের ভাষা। ফ্যাসিবাদ ছাড়া সব বাদ, ইজম ও রাজনীতি ফ্যাসিবাদে অনুপস্থিত থাকে। ফ্যাসিবাদে কোনো রাজনীতি নাই, শুধু ফ্যাসিবাদই আছে। টেন্ডারবাজি, গুম, খুন, ক্রসফায়ার, ফাঁসি, ধর্ষণ, রাহাজানি, দুর্নীতি এসব রাজনীতি না। এগুলো ফ্যাসিবাদ।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের গত ষোল বছরের ভয়ংকর দিনগুলো কিংবা তারও পূর্বের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো রাজনীতির প্রতি তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি করেছিল তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। কিন্তু চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সব ভুল ভেঙে দিয়েছে। রাজনীতি সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নতুন সচেতনতা। দেয়ালে দেয়ালে লেখা হচ্ছে, ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্রশিবির সভাপতি লিখেন, আমরা জানি এই স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছে রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট এবং দলের আওতামুক্ত রাজনীতি সচেতন ছাত্র-জনতা। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানোর চেয়ে বড় রাজনীতি আর কোনো রাজনীতিই না। আমরা চাই সেই রাজনীতির আদর্শে ছাত্র রাজনীতির ব্যাপক ইতিবাচক সংস্কার হবে। ভবিষ্যতের ছাত্র রাজনীতিতে মত-দ্বিমত হবে, যুক্তির পাথরে সবাই বিক্ষিপ্ত হবে, কিন্তু কোনো হকিস্টিক কিংবা স্ট্যাম্প থাকবে না। কোনো গেস্টরুম, গণরুম থাকবে না। চব্বিশের আকাঙ্ক্ষাকে বুকে নিয়ে এগিয়ে যাবে এই ছাত্র রাজনীতি। মধুতে ভিন্নমতের কেউ চা খেলে অপর পক্ষের কেউ তেড়ে আসবে না। একাডেমিক পরিবেশে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে ছাত্র সংসদ ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি।
সাদিক কায়েম আরও উল্লেখ করেন, গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্ন মতের প্রতি থাকবে সম্মান কিন্তু কেউ যেন স্বৈরাচারী না হয়ে উঠতে পারে সে ব্যাপারে রাখতে হবে সজাগ ও পূর্ণ দৃষ্টি। এই রাজনৈতিক সংস্কারে অবশ্যই চব্বিশের শহীদদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকতে হবে, তা না হলে ভেস্তে যাবে আমাদের এই স্বাধীনতা ।
প্রসঙ্গত, ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েমের গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি শহরের বাজার এলাকায়। তিনি খাগড়াছড়ি বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া আদর্শ মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ থেকে কামিল পাশ করেন। । সাদিক এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনে। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেন।
বিএনএ,সৈয়দ সাকিব/এইচমুন্নী