।। ওসমান গনী।।
২১ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে আরেক ট্রাজিক অধ্যায় । ২০০৪ সালের এই দিনে আজকের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে তাকে বাঁচাতে পাড়লেও মহিলা লীগের তৎকালীন সভাপতি আইভী রহমান, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীসহ ২৪ জন নেতাকর্মী এই ভয়াবহ,গ্রেনেড হামলায় মারা যান। সেদিন শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর দুই কান ও চোখ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিএনপি সরকারের সন্ত্রাস-দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সেদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল।একটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে সমাবেশ চলছিল। সমাবেশে শেখ হাসিনা বক্তব্য শুরু করেন ৫টা ২ মিনিটে। ২০ মিনিটের বক্তব্য শেষে ৫টা ২২ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে মাইক ছেড়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় একজন সাংবাদিক তাকে ছবির জন্য একটি পোজ দিতে অনুরোধ করেন। তখন শেখ হাসিনা আবারও ঘুরে দাঁড়ান। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দক্ষিণ দিক থেকে তাকে লক্ষ্য করে একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। গ্রেনেডটি ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেখ হাসিনা ট্রাকের ওপর বসে পড়েন। তার সঙ্গে থাকা অন্য নেতারা এ সময় মানবঢাল তৈরি করে তাকে ঘিরে ফেলেন।
বিকাল ৫টা ২২ মিনিট থেকে এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১৩টি বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ও সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর (অব.) শোয়েব, ব্যক্তিগত স্টাফ নজীব আহমেদসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে তার মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথম দফায় হামলার পর স্টেডিয়ামের দিক হয়ে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত শেখ হাসিনাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘দলীয় সভাপতি যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন, তখনও একই দিক থেকে কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে গ্রেনেড এসে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হতে থাকে। একইসঙ্গে চলছিল তার গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ। এসব গুলি ও গ্রেনেড ঠিক কোথা থেকে ছোড়া হচ্ছিল, তা বোঝা না গেলেও বেশ পরিকল্পিতভাবে যে হামলা হয়েছে, তা পরে বোঝা যায়। সেদিন ১৬ জন মারা যান। পরে আরও কয়েকজন মিলিয়ে ওই হামলার ঘটনায় মোট ২৪ জন নিহত হন। শেখ হাসিনাসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই আহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, বিস্ফোরণের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগ কর্মীরা সেদিন ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এদিকে ঘটনার পর গাড়ি-ঘোড়া চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অনেক স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে বিক্ষুব্ধ কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে থাকে।
এদিকে ঘটনার পর রাজধানীর হাসপাতালগুলো আহতদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে । নেতাকর্মী আর স্বজনদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতাল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, পিজি হাসপাতাল, মিটফোর্ড, পঙ্গু হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, শমরিতা হাসপাতালসহ প্রায় সব হাসপাতাল ভরে যায় গ্রেনেড হামলার আহত রোগীতে। গুরুতর আহতদের ভিড়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। স্থান সংকুলান না হওয়ায় আহতদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়।
গ্রেনেড হামলার পরপরই বিবিসি থেকে ফোন করা হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন। গ্রেনেড যখন বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন নেতাকর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। এখনও আমার কাপড়ে তাদের রক্ত লেগে আছে।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি।
ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের মদদে সারা দেশেই বোমা হামলার ঘটনা ঘটছে। আমাদের এই মিছিলটাও ছিল বোমা হামলা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এ জন্যই তারা জবাব দিলো গ্রেনেড মেরে। আমার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে মুহূর্তে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠবো ঠিক তখনই ওই জায়গাটাই হামলাকারীরা টার্গেট করেছিল। পর পর ৮-১০টা গ্রেনেড ফাটে। এখনও ওখানে দু-তিনটা অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পড়ে আছে। আমাদের মহিলাকর্মীসহ অনেকে নিহত হয়েছেন। এতগুলো মানুষ মারা গেছেন। মানুষের জীবনের কি কোনও মূল্য নেই?’
বিএনএ/’