।। সৈয়দ সাকিব ।।
বিএনএ, ঢাকা: রাজধানীর মোহাম্মদ সাদেক এগ্রো থেকে ১২ লাখ টাকায় ছাগল কেনা মুশফিকুর রহমান ইফাতকে নিয়ে এখন আলোচনা তুঙ্গে। গণ সমালোচনা ও দূর্নীতি দমন কমিশন থেকে বাচঁতে শেষ পর্যন্ত বাবা মতিউর রহমান নিজের ছেলেকে অস্বীকার করেছেন। দেশ জুড়ে ছাগলকাণ্ডের আলোচনা –সমালোচনার মধ্যে হাটে হাড়ি ভেঙ্গেছেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। তিনি ইফাতের আসল পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই হচ্ছে তার বাবা। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) রাতে দৈনিক ইত্তেফাক সংসদ সদস্য নিজামউদ্দিন হাজারীর বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে পুত্র ইফাত ও পিতা মতিউর রহমানের পরিচয় তুলে ধরেছেন।
সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, ইফাত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানেরই দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে এবং তার ভগ্নিপতি। সম্ভবত, রাগ করে মতিউর রহমান ইফাতের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। মতিউর রহমান নিয়মিত দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানেও অংশ নেন। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের দুলা মিয়া কাজি বাড়ি ইফাতের নানা বাড়ি।
তবে সময়ের সঙ্গে ঘোলাটে হয় পরিস্থিতি। পরিবর্তন হয়ে যায় পরিচয়। সম্প্রতি সেই এনবিআর কর্মকর্তা জানান, ইফাত তার ছেলে নন। এমনকি আত্মীয় বা পরিচিতও নন। তাহলে এই ইফাত কে?
অনুসন্ধানে জানা যায়, এনবিআরের সদস্য মতিউর দুটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর নাম লাইলা কানিজ। যিনি বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। মতিউর রহমান প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকেন বসুন্ধরায়। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আক্তারের সন্তান মুশফিকুর রহমান ইফাত। থাকেন ধানমন্ডির ৮ নম্বর সড়কের ৪১ নম্বর বাড়িতে। তার মা থাকেন কাকরাইলের একটি ফ্ল্যাটে। ইফাতের আরেক বোন থাকেন কানাডায়। ইফাতের বয়স ১৯ হলেও ২৩ বছর বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তার রয়েছে বেশ কয়েকটি বিলাসী ব্র্যান্ডের গাড়ী। গেল কুরবানিতে ৭ খামার থেকে অন্তত: ৭০ লাখ টাকার পশু কিনেছেন ইফাত!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন মতিউর রহমান। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন –পিকেএসএফ দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তার। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত কাজ করেন সেখানে। উপ-ব্যবস্থাপক পদ থেকেই ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল যোগ দেন কাস্টমস বিভাগে। ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে কমিশনার হন তিনি।
২০২১ সালের ১২ আগস্ট তাকে কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে সদস্য (টেকনিক্যাল) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
যে ছাগলের দাম নিয়ে এত জল্পনা-কল্পনা, তা হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাতের ছাগল। এ জাতের নাম ‘বিটল’ এবং “বাংলাদেশে এটি এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ছাগল বলে দাবি করেছেন সাদিক এগ্রোর মালিক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন।
আলোচিত ওই ধূসর বাদামি রঙের ছাগলটির ওজন ১৭৫ কিলোগ্রাম এবং উচ্চতা ৬২ ইঞ্চি। “বিরল প্রজাতির এই ছাগল বাংলাদেশে এখন একটিই আছে বলে দাবি করেন বিক্রেতা ইমরান হোসেনের। দুই মাস আগে ছাগলটি যশোরের একটি হাট থেকে ক্রয় করা হয়েছিলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই ছাগলটির ক্রয়মূল্যই পড়েছিলো ১০ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা। তার সাথে আনুষঙ্গিক আরও খরচ আছে। সেজন্যই এর দাম নির্ধারণ করা হয়েছিলো ১৫ লাখ টাকা।
সাদিক এগ্রো বিটল প্রজাতির ওই ছাগলটির দাম ১৫ লাখ টাকা চাইলেও তা ১২ লাখ টাকায় বিক্রির চুক্তি করেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি অবিক্রিতই রয়ে গেছে বলে দাবি করে সাদিক এগ্রো’র ইমরান হোসেন বলেন, “ওই ছেলেটা ছাগলটা ডেলিভারি নেয়নি। এক লাখ টাকা এডভান্স দিয়ে বুক করেছিলো। এ মাসের ১২ তারিখে বাকি টাকা পরিশোধ করে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এরপর আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি, কারণ ওকে আর খুঁজে পাইনি বলেন ইমরান হোসেন।
ঘটনার শুরু গত সপ্তাহে, যখন আলোচিত ছাগল সাথে নিয়ে এক তরুণকে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা যায়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে ওই ক্রেতাকে অন ক্যামেরায় বলতে শোনা যায়, “১১ জুন এটি ধানমন্ডি আট-এ ডেলিভারি দেওয়া হবে।”
ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে ওই তরুণকে বলতে দেখা যায়, “এরকম একটি খাসি কেনা আমার স্বপ্ন ছিল।”
“এরকম খাসি আমরা সামসামনি দেখিনি। আমার জীবনে প্রথম দেখা এটা। এটা আমার হবে, জানা ছিল না। আল্লাহ নসিবে রাখছে, তাই হইছে। এর থেকে বেশি কিছু আর কী বলবো। ২৫ বছর বয়সী একজন এত চড়া দাম দিয়ে কীভাবে ছাগল কেনে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নেটিজেনরা।
ফেসবুকে ফারিবি চৌধুরী নামক একজন লিখেছেন, “চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটির বয়স সর্বোচ্চ ২৫ বছর হবে। এ দেশের সরকারি চাকরিজীবীরা একেকজন বিল গেটস, ইলন মাস্ক, মুকেশ আম্বানি, গৌতম আদানি। সাধারণ সরকারি অফিসারদের ছেলের যদি এ অবস্থা হয়, বুঝেন…”
শরৎ চৌধুরী নামক আরেকজন ফেসবুকে লিখেছেন, “আপনারা হয়ত ভুলে গেছেন, তবে আমি ভুলিনি। যখন দেখি কর্মকর্তার সন্তান লাখ দশেকেরও ওপরে টাকা দিয়ে ছাগল কিনছে, আমি তখন দেখতে পাই সেই রকম কর্মকর্তারাই বেইলি রোডে মানুষ পোড়ানোর সিস্টেমের নানান সার্টিফিকেট দিয়ে এসেছেন।”
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুহাদ্দিস ড. ওয়ালীয়ুর রহমান খান মনে করেন, ঘুষের টাকা ও দুর্নীতির টাকা ছাড়া এত দাম দিয়ে পশু কেনা সম্ভব না এবং সেটি বিবেচনা করলে এটি কোরবানির মূল ধারণার সাথে “সাংঘর্ষিক ও অন্যায়।”
এনবিআর ও দুদুক এই ছাগলকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পিতা মতিউর রহমান ও পুত্র ইফাতের আয়ের উৎসের বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এমন প্রত্যাশায় রয়েছে দেশবাসী।
বিএনএনিউজ/ বিএম