বিএনএ : ভাষা আন্দোলন আমাদের চেতনার ইতিহাস। ভাষার অধিকার আদায়ের সেই রাজপথ রঞ্জিতকরা ইতিহাস এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। দিনটি বিশ্ব আলাদা মর্যাদার সঙ্গে উদযাপনকরে। মহান ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারীকে কেন্দ্র করে অনেক গান- গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটকআমরা পেয়েছি। আসুন জেনে নিই গৌরবময় এই আন্দোলনে যা কিছু ছিল প্রথম।
প্রথম শহীদ :
একুশের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জেরআবদুল লতিফের বড় ছেলে। তাঁর মায়ের নাম রাফিজা খাতুন। সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামেছিল তাঁদের বাড়ি। ঘটনার সময় শহীদ রফিকের বয়স হয়েছিল ২৬ বছর। পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানেগ্যাসের কারণে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ব্যারাকে আশ্রয় নেওয়ারসময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রফিক। গুলিতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তখনইমারা যান তিনি। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ওবায়দুল্লাহর উপস্থিতিতে তাঁর জানাজা পড়ানআজিমপুর মসজিদের ইমাম হাফেজ আবদুল গফুর। সংগোপনে, আত্মীয়-স্বজনের অজ্ঞাতে আজিমপুরকবরস্থানের অসংরক্ষিত এলাকায় দাফন করা হয় শহীদ রফিকের মরদেহ।
প্রথম লিফলেট
একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় একটা কিছুকরার তাগিদে ওই দিনই সন্ধ্যায় আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তফা নূরউল ইসলাম, ফজলে লোহানী,হাসান হাফিজুর রহমান পাটুয়াটুলির সওগাত অফিসের বিপরীত গলিতে অবস্থিত পাইওনিয়ার প্রেসেযান। দুটি টেবিলে বসে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাঁরা লিখে ফেলেন কয়েকটি প্রবন্ধ, নিবন্ধ।তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয়ে যায় একটি বুলেটিন। ‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী, শাসকগোষ্ঠীরকবর রচনা করব।’ বুলেটিনে লিখেছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। এটি ছাপানোর দায়িত্ব পালন করেনহাসান হাফিজুর রহমান। পরে লিফলেট প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘আমি, আমীর আলী (লন্ডনপ্রবাসী)আর একজন আমার সঙ্গে ছিল। আমরা তিনজন জেলখানার উল্টোদিকে ক্যাপিটাল প্রেসে চলে যাই।সেখানে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে প্রুফ দেখে লিফলেটটি ছাপিয়ে আনি। প্রেসটি সেদিন আমাদেরসর্বাত্মক সহায়তা করে।’ রাতেই লিফলেটটি বিশ্ববিদ্যালয় ও পলাশী ব্যারাক এলাকায় বিলিকরে ভাষা আন্দোলনের কয়েকজন কর্মী।
প্রথম প্রকাশ্য জনসভা
একুশের শহীদদের স্মরণে ২২শে ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজারপর একটি সংক্ষিপ্ত সভা হয়। একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রথম প্রকাশ্য জনসভা এটি।এতে সভাপতিত্ব করেন যুবলীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক মহম্মদএমাদুল্লাহ। সভাপতির ভাষণে তিনি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়েযাওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। সভাপতির ভাষণের আগেঅলি আহাদই বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘নূরুল আমীন সরকারের হত্যার জবাব দিবঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মারফত, মাতৃভাষা বাংলাকে পূর্ণ মর্যাদায়প্রতিষ্ঠার দ্বারা।’
প্রথম নাটক
ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে রণেশ দাশগুপ্ত, মুনীর চৌধুরীসহঅনেক লেখক-সাংবাদিকই তখন জেলে। শহীদ দিবসে রাজবন্দিদের অভিনয় উপযোগী করে ভাষা আন্দোলনেরওপর একটি নাটক লিখে দেওয়ার অনুরোধ করে মুনীর চৌধুরীকে একটি চিরকুট পাঠান রণেশ দাশগুপ্ত।মুনীর চৌধুরী ৫৩ সালের ১৭ই জানুয়ারি নাটকটি লিখে শেষ করেন। ওই বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারি,রাত ১০টায় জেলকক্ষগুলোর বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর হ্যারিকেনের আলো-আঁধারিতে মঞ্চস্থ হয়কবর। অভিনয়ে অংশ নেন বন্দি নলিনী দাস, অজয় রায় প্রমুখ। এটিই ভাষা আন্দোলনের প্রথম নাটক।
প্রথম সিনেমা
‘জীবন থেকে নেয়া’ একুশের চেতনানির্ভর প্রথম সিনেমা। ১৯৭০সালের এই সিনেমাটি পরিচালনা করেন জহির রায়হান। সিনেমাটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।স্বাধীনতা আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা রাখে সিনেমাটি।প্রথম উপন্যাসজহির রায়হান রচিত ‘আরেক ফাল্গুন’ একুশের প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটিপ্রথমে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পুস্তক হিসেবে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে।
প্রথম কবিতা সংকলন
একুশের প্রথম কবিতার সংকলন ‘ওরা প্রাণ দিল’ ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরমাসে কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। বিশ পৃষ্ঠার এ সংকলনটির প্রকাশক ছিলেন শিবব্রতসেন। প্রচ্ছদে কাঠের খোদাই করা উডকাট চিত্রে লেখা ছিল, ‘বাংলা ভাষার কণ্ঠরোধ করা চলবেনা।’ প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ভারতের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সোমনাথ হুড়। বিমল চন্দ্র ঘোষ,সৈয়দ আবুল হুদা, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, মুর্তজা বশীর, নিত্য বসু, তানিয়া বেগম ও প্রমথ নন্দীএই ৭ জনের কবিতা স্থান পেয়েছিল সংকলনে।
প্রথম ক্রোড়পত্র ও স্কেচ
১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি একুশের প্রথম ক্রোড়পত্র এবং প্রথমস্কেচ প্রকাশিত হয়। তৎকালীন দিলরুবা পত্রিকার প্রকাশক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন। স্কেচআঁকেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম। লেখেন ফয়েজ আহমদ এবং আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন। বিকেলপাঁচটার মধ্যে কাগজ ছাপা হয়ে যায় এবং পত্রিকার কর্মীরাই রাজপথে কাগজগুলো বিলি করেন।সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ থাকায় ৬টার আগেই হাতে হাতে কাগজ বিলি করা হয়ে যায়।
একুশের প্রথম ছাপচিত্র
৫২’র প্রথম ছাপচিত্র আঁকেন মুর্তজা বশীর। ছাপচিত্রটির শিরোনামছিল ‘রক্তাক্ত একুশে’। মুর্তজা বশীর ২১শে ফেব্রুয়ারির ছাত্রহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাঁর এই ছাপচিত্রটিতে তিনি এঁকেছেন একুশের ঘটনা। ছাপচিত্রটিতেদেখা যায়, একজন ছাত্রনেতা মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান, পড়ে যায় তার স্লোগান সংবলিতপ্ল্যাকার্ডটি। হাতে থাকা বইটিও মাটিতে পড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়।
পূর্ববঙ্গ পরিষদে প্রথম বক্তব্য
জনাব স্পিকার সাহেব, প্রশ্নোত্তরের পূর্বে আমি আপনার কাছেএকটা নিবেদন করতে চাই। যখন দেশের ছাত্ররা, যারা আমাদের ভাবী আশা-ভরসাস্থল, পুলিশেরগুলির আঘাতে জীবনলীলা সাঙ্গ করছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাই না। প্রথমেইনকোয়ারি, তারপর হাউজ চলবে।’ আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এর এই বক্তব্যই একুশে ফেব্রুয়ারিছাত্রহত্যার প্রতিবাদে আইন পরিষদে প্রথম বক্তব্য।
আইন পরিষদ থেকে পদত্যাগকারী প্রথম সদস্য
একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গপরিষদের সদস্যপদ থেকে প্রথম পদত্যাগ করেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন।গভর্নর ও পরিষদের স্পিকারকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলাকে পাকিস্তানেরঅন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করায় ছাত্রদের ওপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে, তাহারপ্রতিবাদে আমি পরিষদে আমার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নূরুল আমীন সরকারের আমিওএকজন সমর্থক, এ ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এত দূর লজ্জাজনক যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এই দলেরসহিত সংযুক্ত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি।’
বিএনএনিউজ/মো. হাসান মুন্না।