।। মিজানুর রহমান মজুমদার।।
বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে অমর কাব্যগন্থ্য ‘গীতাঞ্জলী’ রচনা করেন এবং বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পুরস্কারে ভূষিত হন । তখন থেকে বিশ্বের কাছে বাংলা ভাষাকে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রক্ত দিয়ে বাঙ্গালী জাতি ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি এই দিনটি বাঙ্গালী জাতির জীবনে, গৌরবোজ্জ্বল, অহংকারে মহিমান্বিত চিরভাস্বর ও শোকাবহ । ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ।
বাঙ্গালী ছাড়া পৃথিবীর কোন জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে এমন নজির দ্বিতীয়টা নেই! ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান নামক দেশটি মানচিত্রে স্থান পায়। এর ১৫ দিন পরই ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা-না উর্দু ?’ এই পুস্তিকার লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমেদ এবং অধ্যাপক আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে ভাববিনিময়, অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো দাবি তুলে ধরেন।
এই অবস্থায় ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ জানান। তিনি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পাকিস্তান গণপরিষদে তার প্রস্তাব আগ্রাহ্য হলে পূর্ব পাকিস্তানে উত্তাল হয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ।
২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চ সারা দেশে সর্বাত্বক হরতাল পালিত হয়।
২১ মার্চ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক নাগরিক সংবর্ধনায় ঘোষণা করেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্রনেতারা ও জনতা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে।
এর তিন দিন পর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘Students Role in nation building’ শিরোনামে এক সেমিনারে ভাষণ প্রদানকালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে।’
জিন্নাহর এই বক্তব্য সমাবর্তনস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ছাত্ররা দাঁড়িয়ে ‘‘নো নো’’ বলে প্রতিবাদ করে এবং তার ভাষণ বয়কট করে।
৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্যের ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়’। সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাললের ডাক দেয়া হয়। এদিন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও সফিউল সহ অনেকে।
১৯৫২ সালের একুশের ধারাবাহিকতায় হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালি ভাষা সৈনিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের নেত্তৃত্বে ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক একটি এদেশের জন্ম হয়। স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষাকে সত্যিকার অর্থে বিশ্বায়নের পূর্ণরূপ দেয়ার জন্য জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ২৩ মার্চ জাতিসংঙ্গের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলাকে বিশ্বায়ন করেছেন। তার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো সারা বিশ্বে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০০১ সালের ১৫ মার্চ বিশ্বের সব মাতৃভাষার গবেষণা, উন্নয়ন ও সংরক্ষণে কাজ করার উদ্যোগে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভাষাসংক্রান্ত গবেষণা,ভাষা সংরক্ষণ ও কাজ করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা প্রদেশ, আসাম প্রদেশের বরাক উপত্যকার অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা, ফলে ভারতের ক্ষেত্রে বাংলা একটি প্রদেশিক ভাষা। ভারত উপমহাদেশের বাইরে একমাত্র আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
বিশ্বে ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ, সেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি পড়ুয়া বাংলাভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছে। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সংসদ বাংলাকে স্বীকৃতির বিল পাস করে। ফলে বাংলা ভাষা লাভ করে এক অনন্য মর্যাদা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে বাঙ্গালী জাতিকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও মর্যদা বৃদ্ধির জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি নাগরিক বান্ধব ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।