আসসালামু আলাইকুম।২০১১ সালের ১৮ মে’ এদিনে তোমাকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছি। তুমি যখন বেঁচে ছিলে তখন অনেক আদর্শের কথা বলতে, আর সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য অনেক অনেক পড়তে বলতে। কিন্তু আমার পড়া ভালো লাগতো না। অংক-ইংরেজিতে প্রায় ফেল করতাম। তোমার চোখ রাঙ্গানি, প্রাইভেট শিক্ষকের বকাঝকা, স্কুলে স্যারের বেত্রাঘাত কোন ঔষধ কাজ দেয়নি। অনেকটা বর্তমানে চলমান মহামারি করোনা ভাইরাসের মতো! মার্কসিটে নম্বরের আগে শুণ্য থাকলে আমি খুব খুশি হতাম! এ খুশির কারণ শুণ্যের উপরে বা নিচে একই কালি দিয়ে একই সাইজের আরো একটা শুণ্য বানিয়ে দিতাম! যখন তুমি মার্কসিট চাইতে তখন দিতাম না। খুঁজে পাচ্ছি না বলে জবাব দিতাম। তুমি খোঁজার জন্য তাগিদ দিতে। তুমি জানতে চাইতে অংক আর ইংরেজিতে কত নম্বর পেয়েছি? বলতাম শুণ্যের পরিবর্তে ৪ যুক্ত করে। যেমন ৪৯,৪৮,৪৭,৪৬,৪৫,৪৪, এভাবে! তোমার ছেলে এত ভাল নম্বর পাবে এটা তোমার বিশ্বাস হতো না। তুমি বলতে মার্কসিট দেখাও।
অপেক্ষায় থাকতাম তুমি কখন অফিসে যাবে সেই মহাক্ষণটির জন্য। আর মনে মনে সুরা এখলাছ পড়তাম। মা একবার বলেছিল কোন বিপদ আসলে যেন সুরা এখলাছটা পড়ি! আমার বিপদতো ওই মার্কসিট দেখানোর সময়।দৌড়ে গিয়ে তোমাকে বলতাম ‘বাবা-বাবা মার্কসিট পেয়েছি। মার্কসিট আমার হাতে রেখে তোমাকে জোর করে দেখাতাম এই দেখেন অংক ও ইংরেজির নম্বর। তুমি বলতে এত কম? বকাঝকা করতে করতে বের হয়ে যেতে । আমি মনে মনে চিন্তা করতাম, তুমি যদি আসল নম্বরটা জানতে তাহলে তো জানে মেরে ফেলতে! ক্লাস টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়ার কল্যাণে বিশেষ বিবেচনা পাশ করে পরের ক্লাসে ভর্তি হয়ে যেতাম।
বাবা, তোমার ইচ্ছা ছিল আমাকে ডাক্তার বানানো! আমার কী অতবিদ্যা আছে? ওই সময়তো আমার প্রিয় বন্ধু ছিল ইবলিস! সেতো আমাকে পড়তে বারণ করতো। আমার লেখাপড়ার ভাব দেখে আমার ক্লাস টিচার অজিত স্যার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’। জলসা, নুপুর, উজালা, লায়ন, মেলডি,আলমাস,রঙ্গম, খুরশীদ মহল সিনেমায় বেশির ভাগ সময় বন্ধুদের নিয়ে গ্রুপ স্ট্যাডি করেছি! এসএসসি’র ফলাফল যা হবার তা হয়েছে। তুমি হতাশ হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলা, হাত খরচও দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলে। তুমি হতাশ হলেও আমি হতাশ ছিলাম না! আমি দুপুরে তোমার ঘুমানোর অপেক্ষায় থাকতাম। তোমার পকেটে অনেকগুলো ভাংতি পয়সা থাকতো। এর একটা অংশ নিয়ে পালিয়ে যেতাম ফুটবল খেলার মাঠে। ওই সময়ে ৫০ পয়সার আধুলি ছিল আমার ফেবারিট!
মাধ্যমিকে চট্টগ্রাম কলেজে বিজ্ঞানে ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করিনি। সরকারি সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম বিজ্ঞানে। আমাকে ডাক্তার বানানোর আশা তুমি তখনও ছাড়নি। তোমার এ সরলতার সুযোগটা এবার পুরোপুরি নিলাম। আবদার করলাম মোটর সাইকেল লাগবে! তাও দিলে। কলেজে আমার বিশেষ কদর! রাজনীতির বড় ভাইরা এবার আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। যুক্ত হয়ে গেলাম ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। কলেজ সংসদের নেতা হলাম।
এইচএসসি পাশ করলাম। রাজনীতির বড় ভাইরা মিটিং করলেন। তারা সিদ্ধান্ত দিলেন চট্টগ্রাম কলেজে যেন ভর্তি হই। হলামও। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হল, চট্টগ্রাম কলেজে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ছাত্রলীগকে ফের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার। ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তৎপর হতেই ছাত্রশিবিরের রোষানলে পড়লাম। পোড়ানো হলো শখের মোটর সাইকেল। দায়ের করা হল ১৮টি মামলা! চট্টগ্রাম শহরের কোথাও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী ‘উষ্টা’ খেয়ে আহত হলেই আমার নামে একটা মামলা দেয়া হত! পরের বছর ড.মুনির স্যারের সহযোগীতায় ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিজ্ঞানে।
বাবা, আমার আচরণে তুমি হতাশ । একদিন খাবার টেবিলে পেয়ে বলে উঠলে তোকে এত টাকা খরচ করে বিজ্ঞান পড়তে বলেছিলাম কী এ জন্য? বাবা আমি তো এখনো বিজ্ঞানে পড়ছি, বাবা বললেন মানে? রাজনীতি বিজ্ঞান হল কখন? বললাম, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই’ সূত্র আবিস্কার হওয়ার পর থেকে! এবার তুমি বললে, ‘তুইতো দেখছি, না পড়েই রাজনীতি বিজ্ঞানী হয়ে গেলি!
বাবা, তোমার মনে পড়ে, হঠাৎ একদিন গভীর রাতে ডবলমুরিং থানা ও ডিবি পুলিশ আমাদের আগ্রাবাদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। গেইট ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম। বড় ভাই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে বললেন, পুলিশ! ভাইয়ার রুমের দরজা দিয়ে ছাদে যাওয়া যায়। আমি ছাদে চলে গেলাম। কিন্তু ছাদে থাকাটা নিরাপদ মনে হয়নি। ছাদ লাগোয়া পাশের বাড়ির নারিকেল গাছ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমার পায়ের ভারে নারিকেল গাছের একটা মরা ডোগা ভেঙ্গে পড়ল। ফেটে গেল পুলিশের মাথা। ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার দিতে দিতে রাইফেল তাক করলো। নিশ্চিত মৃত্যু। জীবন বাঁচাতে নারিকেল গাছ থেকে লাফ দিলাম। পড়লাম, প্রতিবেশির বাড়ির পিছনে। সেখানে আগে থেকে কিছু বালি স্তুপ করা ছিল। বেঁচে গেলাম! দৌড়ে গিয়ে বেপারি পাড়ার এক বাড়ির রান্না ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
এদিকে ভাইয়াকে আটক করে নিয়ে গেছে পুলিশ। তোমাকে সকালে থানায় যেতে বললেন। তুমি পুলিশের সরল কথা বিশ্বাস করে থানায় গিয়েছিলে। তখন ওসি ছিলেন সম্ভবত, হুমায়ন কবির। তুমি এবং ভাইয়াকে মিথ্যা মামলা দিয়ে আদালতে সোর্পদ করা হল। শুধু তাই নয়, ৩ দিনের রিমান্ডও চাইলেন! খবর পেয়ে আদালতে ছুটে এলেন জামাল চাচা (জেইউ চৌধুরী)সহ স্বজনরা। ছুটে এলেন আমার বন্ধু বাবলু, মাহবুব ও সোবাহান।
সেদিন আদালতের বারান্দায় আমাকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন জামাল চাচা। কোমড় থেকে পিস্তল বের করে দৌড়ে আমার দিকে আসলেন, আর বললেন, ‘তোর মতো ছেলে দরকার নেই, তোরে আজকে মেরেই ফেলবো!’
বাবা, আমি সে দিন থেকে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি। তখনও আমি ১৮টা মামলার হুলিয়া প্রাপ্ত আসামি! বন্ধু মাহবুব তার বাসায় আত্মগোপনে থাকা এবং লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। পরীক্ষার আগের দিন পরীক্ষার প্রবেশপত্র আনার জন্য ক্যাম্পাসে গেছি। ক্যাম্পাস থেকে ফিরতেই আক্রমণ পায়ের রগ কাটার চেষ্টা করলো! রাগ কাটতে না পারলেও অসংখ্য ছুরি বসালো আমার পুরো দেহে। আল্লাহ অসীম রহমত এবং কুদরত আমার চিৎকারে অনেক ছাত্রী আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে এলো। হাসপাতালে ভর্তি হলাম, মাথায় ১৪টা সেলাই। সবাই বলল, পরীক্ষা না দিতে।
বাবা, তুমি জান আমার ইচ্ছা শক্তি খুবই প্রবল ও প্রচন্ড জেদি। আমি ভাইয়াকে বললাম পরীক্ষা দিব, ব্যবস্থা করতে। ভাইয়া আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক ড. আ.ন.ম মুনির আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন। স্যার আমাকে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ নিয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। আর সেই পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি! তারই ধারাবাহিকভাবে অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি গবেষণা করেছি। একজন সৎ, পেশাদার, ব্যক্তিত্ববান, দুর্নীতিমুক্ত সাংবাদিক হিসাবে নিজেকে দাবি করি। যদিও আমি সেলিব্রেটি সাংবাদিক হতে পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু তোমার আদর্শ এবং মুনির স্যারের পরামর্শে আমার ঝুলিতে এখন অনেক সফলতার সনদ।
বাবা, চিঠিটা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। তোমার আবার ধৈর্ষ্যচ্যুতি হতে পারে। শেষ করার আগে একটু পিছনে ফিরতে চাই। হাইস্কুলে অংকে এবং ইংরেজিতে কখনো কখনো আমি দুই শুণ্য পেতাম। কিন্তু ‘রাজনীতি বিজ্ঞানে পড়তে এসে আমি দুই শুণ্যের আগে ১ যোগ করতে সমর্থ হয়েছি ছাত্র শিবিরের কল্যাণে ! ক্যাম্পাসে গিয়ে ক্লাস করার সুযোগ কমই হয়েছে। সেকারণে আমার সহপাঠিদের অনেকে আমাকে চিনেন না। তবে নাম শুনেছে। সক্রোটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, হবস, লক, রুশো, মার্কস, ইবনে খালেদুন, ম্যাকিয়াভেলী, হিটলার, রাশিয়ার গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি নীতি, জিন্নাহ, গান্ধী, এম এন রায়, বঙ্গবন্ধু, জিয়া, এরশাদ সমসাময়িক রাষ্ট্রতত্ব খুব ভালভাবে বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে।
বাবা, তুমিতো আমার শিক্ষা গুরু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক কৃতি ছাত্র আনোয়ার ভাই (প্রয়াত)কে চিনতে। তিনি আমাকে বইয়ের ভেতরে ও বইয়ের বাইরের রাজনীতি, কূটনীতি পড়াতেন। তার হামজারবাগ মেসে আমার অন্তত সপ্তাহে তিনদিন যাওযা হতো। যা কিছু সামান্য শিখেছি,তা আনোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে। তুমি, আনোয়ার ভাই এবং মুনির স্যার যদি আর কিছুদিন বেঁচে থাকতে। আমার শির আরও উঁচু হতো। আমিও নিজেকে রাজনীতি বিজ্ঞানী হিসাবে দাবি করতে পারতাম। সেটাতো আর হয়ে ওঠেনি।
বাবা, আজ তুমি নেই। তোমাকে খুব মনে পড়ে, মনে পুড়ে। বাবা সবার থাকে। কিন্তু তোমার মতো বাবা সবার হয় না। তুমি আমাকে শাসন করলেও অনেক ভালবাসতে। রবি ঠাকুরের সেই বাক্যটার মতো ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’। তোমার ভালবাসা যদি না পেতাম তা হলে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় আমার নাম থাকতো! কারাগার হতো স্থায়ী নিবাস। আমি এ পর্যায়ে এসে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি শুধু তোমার কারণে, তোমার ভালবাসায়।
বাবা, ওই সময়ে আমার রাজনৈতিক গুরুরা শুধু বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। তুমি আমার ১৮ টা মামলার দায়িত্ব নিয়েছিলে। এক পাল্লায় আমি, আরেক পাল্লায় তোমার টাকা! আদালতে আইনি লড়াই করে আমাকে লেখাপড়া ও সাংবাদিকতা করার সুযোগ দিয়েছ। নিজের হাতে হ্যান্ডকাপ তুলে নিয়েছ, পিস্তলের সামনে বুক পেতে দিয়েছ, নিজের জমানো লাখ লাখ টাকা খরচ করতে দ্বিধা করনি। মাস্টার্স পাশ করার পর চাকরি কিংবা ব্যবসা করতে চাপ দাওনি। বরং উচ্চ শিক্ষার জন্য উৎসাহিত করেছ। শিবিরে জ্বালিয়ে দেয়া পুরাতন মোটর সাইকেলের পরিবর্তে নতুন মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছ। আমি সৌভাগ্যবান। তোমার মতো বাবা পেয়েছিলাম বলেই সমাজ, রাষ্ট্র আজ আমাকে চিনে, জানে!
বাবা, আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। চেনার বা জানার চেষ্টা করেনি। পৃথিবীর সব বাবা যদি তোমার মতো হত! পৃথিবীটাই স্বর্গ হত। যতদিন তোমার ছায়া ছিল মনে হয় স্বর্গে ছিলাম। স্বর্গ সুখ আমার কাছে এমনই। তোমার অভাব আমি প্রতি মুহুর্তে অনুভব করি। বুকে তুষের আগুনের মত দগ্ধ হই। তুমি এভাবে হঠাৎ চলে যাবে তা কখনো কল্পনায় আনিনি। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও হল না! কী শহরে, কী গ্রামে তোমার তোমার তৈরি করা রাজপ্রাসাদে আমি একাই থাকি। চারিদিকে শুধু তোমার স্মৃতি চিহ্ন। যেদিকে তাকাই সেদিকে তুমি! চোখ ভিজে যায়। পরপারে কেমন আছ বাবা? ‘মা’ ও তুমি কবরে পাশাপাশি আছ! এতেই তো তোমার শান্তি! আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের সুখ ও শান্তিতে রেখেছেন।