বিএনএ, রিপোর্ট : ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বৃহত্তর নোয়াখালী (বর্তমানে ফেনী ) জেলার আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি সুলতান আহমেদ মজুমদার এর ২৬তম মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে মঙ্গলবার(১৮মে) সুলতান আহমেদ ফাউন্ডেশন, পোর্টল্যান্ড গ্রুপ ও পরিবারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম শহর ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় দিন ব্যাপি স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন কর্মর্সূচি পালিত হয়েছে। করোনা মহামারীর কারণে এবছরও বড় কোন জমায়েত বা মেজবানের আয়োজন করা হয় নি।
কর্মসূচির মধ্যে ছিল ছাগলনাইয়া উপজেলার উত্তর যশপুরের রওশন ফকির দরগাহ মাদ্রসায় কোরআন খতম দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, এতিম ছাত্রদের জন্য তবরুক বিতরণ এবং চট্টগ্রামের দক্ষিণ খুলশির ঝাউতলায় জামেয়া ইসলামীয়া মাদ্রাসা ও আলকরণস্থ এতিম মেয়ে শিশুদের লালনকারী সংগঠন ‘উপলব্ধি’তে অনুরুপ খাদ্য বিতরণ করা হয়।
তাছাড়া আগ্রাবাদ বারিক বিল্ডিং মোড়স্থ পোর্টল্যান্ড সাত্তার টাওয়ারে পোর্টল্যান্ড গ্রুপের উদ্যেগে নিজস্ব এবাদত খানায় মঙ্গলবার বাদ আছর দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে গ্রুপের পরিচালকগণসহ সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন।
মাহফিলে মরহুম আলহাজ সুলতান আহমেদ মজুমদার এবং তার স্ত্রী মরহুমা নূরের নেছার রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়।
তাছাড়া মরহুম আলহাজ সুলতান আহমেদ মজুমদার এবং তার স্ত্রী মরহুমা নূরের নেছার তৃতীয় পুত্র,পোর্টল্যান্ড গ্রুপের পরিচালক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জনাব জাকির হোসেন এর দ্রুত আরোগ্য কামনা করে দোয়া ও বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
উল্লেখ যে, ১৯২০ সালে ভারত সীমান্ত লাগোয়া ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার উত্তর যশপুর হাজীবাড়ী সামন্ত জমিদার কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সুলতান আহমদ। তার পিতার নাম আব্দুল হামিদ ও মাতা জামিলা খাতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সুলতান আহমদ এন্ট্রান্স (এসএসসি) পাশ করেন।বাপ-দাদা সামন্ত জমিদার কৃষক হলেও তিনি পুরাতন ঢাকা চকরাজারে ব্যবসা করতেন। প্রতিষ্ঠা করেন সিলোনিয়া ট্রেডার্স।১৯৯৫ সালের ১৭ মে দিবাগত রাতে ছাগলনাইয়া আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সুলতান আহমদ ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৭ ছেলে ও ৪ মেয়ের জনক। তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত ও যৌথ পরিবারে বসবাস করেন।
প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ি হিসাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সর্ম্পক গড়ে ওঠে। তারই অনুপ্রেরণায় ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফন্ট নির্বাচন, ৬৬ সালে ৬ দফা, ৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান, ৭০ সালে নির্বাচন সর্বোপরি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন সুলতান আহমদ। নেতৃত্ব দেন ছাগলনাইয়া আওয়ামী লীগের।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিলোনিয়া ট্রেডার্স নামের টায়ার টিউব ব্যাটারি ও সৌখিন পণ্যের আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান ও লাগোয়া গুদাম জ্বালিয়ে দেয় বিহারীরা। তাদের কাছে তথ্য ছিল প্রতিষ্ঠানটির মালিক সুলতান আহমদ আওয়ামী লীগের নেতা। সহায়-সম্বল হারালেও মনোবল হারাননি। ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার পাশাপাশি অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দিতে থাকেন। কিন্তু বিষয়টি গোপন থাকেনি। বিষয়টি স্থানীয় রাজাকাররা পাক বাহিনীকে জানিয়ে দেয়। এরপর থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী এ নেতা ও তার পরিবারের ওপর নেমে আসে পাক বাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের নির্মম নির্যাতন। তাকে হত্যা করার জন্য কয়েক দফা প্রকাশ্যে ও গোপনে অভিযান চালানো হয়। এ অবস্থায় পরিবার পরিজন নিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যান সুলতান আহমদ। পরে নিজে ও তার বড় সন্তানরা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও তাদের সহায়তা করতে থাকে। তার বাড়িতেই মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার ক্যাম্প স্থাপন করেন।
বাড়ির চার পাশ ও পুকুরপাড়ে ২৯টি বাঙ্কার খনন করে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে যুদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক সেনাদের থেমে থেমে অন্তত: ৯ দিন যুদ্ধ হয়। পিছু হটতে বাধ্য হয় পাক বাহিনী। এতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রাজাকাররা। ১৯৭১ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্থানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ছাগলনাইয়া থানা সদরে রাজাকার ও পাক বাহিনী এক সমাবেশ হয়। সেখান থেকে পরিকল্পনা হয় সুলতান আহমদকে হত্যা ও তার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার।ওইদিন দুপুরের দিকে রাজাকারদের একটি দল তার বাড়িতে ভাঙ্গচুর ও লুটপাট চালায়। জ্বালিয়ে দেয় পুরো বাড়ি। তাতেও তাদের ক্ষোভ দমেনি, সুলতান আহমদকে না পেয়ে তার এক চাচাতো ভাইকে হত্যা করে উল্লাস প্রকাশ করে।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহমদ কয়েক সহযোগিকে নিয়ে বিলোনিয়ায় অবস্থানরত তৎকালীন ক্যাপ্টেন অলি আহমদের (বর্তমানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পাটির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব:) ড. অলি আহমদ) কাছে যান। যশপুরসহ পুরো ছাগলনাইয়া মুক্ত করতে তার সহযোগীতা কামনা করেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন অলি আহমদের নেতৃত্বে ছাগলনাইয়া থানার উত্তর ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী থানার অংশ বিশেষ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহমদ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে মনোযোগী হন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষাই বাঙ্গালী জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।তারই পৃষ্টপোষকতায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, এতিমখানা।এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ণে তিনি সরকারি বরাদ্দ আনার ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হননি পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে যুক্ত হন। প্রসঙ্গত: দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক গ্রুপ পোর্টল্যান্ড মরহুম সুলতান আহমদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। পোর্টল্যান্ড গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তার ছেলে এম নুরুল হোসেন খোকা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান মজুমদার, পরিচালক (অর্থ) জাকির হোসেন, পরিচালক (মানব সম্পদ ও প্রশাসন) রবিউল হোসেন বাবু, পরিচালক (ক্রয় ও সরবরাহ) মোমিনুর রহমান। এছাড়া তার বড় দুই সন্তান কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তারা হলেন মরহুম আবুল কালাম আজাদ ,সাবেক জেনারেল ম্যানেজার, মিচুয়্যাল গ্রুপ এবং এএস মহিউদ্দিন, এসভিপি ও হেড অব রিচার্স এন্ড প্ল্যানিং ডিভিশন মাকেন্টাইল ব্যাংক।
বিএনএনিউজ২৪/এসজিএন