বিএনএ,ডেস্ক : সামিট গ্রুপ বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ খাতের সুপরিচিত এক নাম। সামিট গ্রুপের কর্ণধার আজিজ খানের ব্যবসার শুরুটা হয়েছিল জুতা, পিভিসি সামগ্রী, পলি ভিনাইল ক্লোরাইড ও চিটাগুড়ের ব্যবসা দিয়ে। পুঁজি ছিল মাত্র ৩০ হাজার টাকা।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে বিদ্যুৎ ব্যবসায় যাত্রা শুরু করে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০১ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩৩ মেগাওয়াটের ৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে সামিট গ্রুপ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিজের ভাই কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা এবং মন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ফারুক খানের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সরকারের সঙ্গে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি করে তারা। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে, অন্যতম, সামিট গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ আজিজ খান। ২০১০ সালে বিদ্যুতের দায়মুক্তি আইন পাস হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার কোটি টাকা লুটের পথ আরও সুগম হয় তাদের।
অল্পসময়ে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে সিঙ্গাপুরে গড়ে তুলেছেন সাম্রাজ্য, নিয়েছেন নাগরিকত্বও। পাশাপাশি সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ধনীদের তালিকায়ও উঠে এসেছেন, দুর্নীতির বরপুত্রখ্যাত আজিজ খান। গত ১৫ বছরে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও টেলিকম ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে গ্রুপটি।
বর্তমানে সামিট পাওয়ার এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের দুই হাজার ৫৩২ মেগাওয়াটের ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এরমধ্যে ৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্যে দেখা গেছে, ১৩২৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ওই ৭ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে, প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে ১২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকারও বেশি। বিদ্যুৎ খাত ছাড়াও এলএনজি ব্যবসা, টেলিকম ও ইন্টারনেট খাতে একক আধিপত্য বিস্তার করে, হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয় সামিট গ্রুপ।
বারবার সামিট গ্রুপের অনিয়ম ও দুর্নীতি আলোচনায় এলেও, ব্যবস্থা নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। তবে ইতোমধ্যে, সামিট গ্রুপের দুর্নীতির তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর অংশ হিসেবে আজিজ খান ও তার পরিবারের ১১ সদস্যের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে; বাতিল করা হয়েছে সামিট গ্রুপের সঙ্গে দ্বিতীয় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তিও। পর্যালোচনা করা হচ্ছে সামিটের সঙ্গে করা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তিও। এ ছাড়া সামিটের টেলিকম ব্যবসার বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনার জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, জুনায়েদ আহমেদ পলক, সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমানসহ কয়েকজন সামিট গ্রুপকে সুবিধা দিতে সবসময় তৎপর থাকতেন। তাদের আশীর্বাদে টেন্ডার ছাড়াই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প দেওয়া হয়। দেওয়া হয় সরকারি জমি, কর ছাড়, প্রণোদনা দিয়ে জ্বালানি তেল আমদানিসহ নানা সুযোগ। আবার দফায় দফায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়িয়ে, বাড়তি অর্থ আয়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের অতিঘনিষ্ঠ হওয়ায়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও টেলিকম খাতে একক আধিপত্য তৈরি করে, সামিট গ্রুপ। শুধু দেশের বিদ্যুৎ খাত থেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে এখন সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর তালিকায় ৪১তম অবস্থান তার। বর্তমানে তার নিট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
গত ১৫ বছরে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গ্রুপটির আয়ও একই পরিমাণ টাকা। এ ছাড়া বিশ্বের ৭৮টি দেশের শত কোটিপতিদের তালিকায় ২ হাজার ৭৮১ জনের মধ্যে তার অবস্থান ২ হাজার ৫৮২তম। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিকস ও আবাসন খাতসহ, ২০টিরও বেশি খাতে ব্যবসা রয়েছে সামিট গ্রুপের।
অর্থ পাচারসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে ২০১৬ সালে পানামা পেপারসে সামিট গ্রুপের আজিজ খানের পাশাপাশি তার স্ত্রী আনজুমান ও মেয়ে আয়েশার নাম শীর্ষে উঠে আসে। দুর্নীতি দমন কমিশন, ক্ষমতার প্রভাব আর আইনি জটিলতায় গত ৮ বছরেও অনুসন্ধান শেষ করতে পারেনি।
আজিজ খান এর পাশাপাশি সামিট গ্রুপের দ্রুত এগিয়ে চলার নেপথ্য কারিগর তার মেয়ে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আয়েশা আজিজ খান! তার সঙ্গে ছিল হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরকীয়া! তার জেরে আয়েশা আজিজ খান তার স্বামী ইসাম খন্দকারকে ডিভোর্স দেন। তাদের দুইজনের সন্তানও রয়েছে।
শুনা যায়, জয় ও আয়েশা ৪বছর আগে বিয়েও করেছেন! সেকারণে সামিট গ্রুপ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি পৃষ্টপোষকতা পান। তারা সিঙ্গাপুরের একটি বিলাস বহুল বাড়িতে বসবাস করেন। অপরদিকে জয়ের আগের আমেরিকান স্ত্রী, তার পূর্ব স্বামী রিচার্ড লুমিসের সাথে রীতিমত ঘর সংসার শুরু করে দিয়েছে। কারণ তাদের বিয়েটা হয়েছিল ওপেন ম্যারেজ বা ফ্রিডমের ওপর ভিত্তি করে। সোফিয়া নামে তাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। সে ক্রিস্টিনার সঙ্গেই থাকছে। জনশ্রুতি আছে, ডিভোর্সের জন্য ক্রিস্টিনাকে জয় পরিশোধ করেছে ২ বিলিয়ন ডলার!
সম্প্রতি সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-এফবিআই এর একটি রিপোর্ট ফাঁস করা হয়। জয়ের দাবি, রিপোর্টটি ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে ভরা। এফবিআইয়ের ওই রিপোর্ট মিথ্যা প্রমাণ করতে গিয়ে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের এক পোস্টে জানান, ‘ক্রিস্টিনা এবং আমি আর একসঙ্গে নেই। আমরা প্রায় তিন বছর আগে আলাদা হয়েছি।’
হাসিনা পুত্র জয় তার মার্কিন স্ত্রী ক্রিস্টিনার সঙ্গে ডিভোর্সের বিষয়টি নিয়ে মুখ খুললেও, আজিজ কন্যা আয়েশাকে বিয়ের ব্যাপারে এখনও মুখে কুলুপ এটে আছে। ফলে জয়-আয়েশার বিয়ের ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
সৈয়দ সাকিব