ভারতের দিল্লিতে থাকা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২০ দেশের ২০ জন এবং ঢাকায় থাকা ৭ জনসহ ২৭ জন রাষ্ট্রদূত আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে ঢাকায় আসছেন। খোদ প্রধান উপদেষ্টা রোববার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে এ তথ্য জানান।

এমন সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠক করতে যাচ্ছেন, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ডোনাল ট্রাম্পকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে যাচ্ছেন। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্ম্পক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ড. ইউনূসের এই বৈঠক রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক অঙ্গনে নানা জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়েছে। কৌতুহল রয়েছে রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি সচেতন মানুষের মধ্যে।
গত রোরবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন পূর্তির দিনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্ট বৈঠক করেছেন।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীসরকার জাতীয় ঐক্য ত্বরান্বিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক সহঅবস্থান এবং আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সহ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় যুক্তরাজ্য।
গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এই প্রথম যুক্তরাজ্য সরকারের কোনো জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করলেন। এতে একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের সমর্থক ইসলামী দলগুলো এতদিন আওয়ামী লীগ, জাতীয়পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি তুলেছে। তার প্রতি সমর্থন দেখিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগসহ ২৬টি রাজনৈতিক দলকে যে হিট লিষ্টে রেখেছে। তার প্রতি সমর্থন নেই যুক্তরাজ্যের।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২০ দেশের ২০ জন রাষ্ট্রদূত দিল্লিতে থাকেন। সাত দেশের সাত রাষ্ট্রদূত ঢাকায় আছেন। দিল্লি থেকে একসঙ্গে ২০ জন রাষ্ট্রদূতসহ মোট ২৭ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সমবেতভাবে তার সঙ্গে বৈঠক করার জন্য আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকায় আসছেন।
তিনি বলেন, আগে কখনো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭ জন রাষ্ট্রদূত একত্রিত হয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি। দিল্লি থেকে এ বিশাল সংখ্যক রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে বৈঠক করার জন্য আসেনি।
ড. ইউনূস বলেন, তিনি যখন সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেন, সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা, ইতালি, হল্যান্ড, জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিশ্বের অনেক দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে তার বৈঠক করার সুযোগ হয়। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সরকারের সফলতা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার যে গল্প শুনিয়েছেন তার সঙ্গে ভিন্ন মত রয়েছে ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকদের। যার ইঙ্গিত রয়েছে যুক্তরাজ্যের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্টের কথায়। তিনি স্পষ্ট করেছেন, বাংলাদেশকে দ্রুত গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে হবে। ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে জনগণের প্রতিনিধির কাছে। এর বিকল্প নেই। সংস্কারের নামে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার চিন্তা থেকে অন্তর্বতীকালীন সরকারকে সরে আসতে হবে।
আসন্ন ২৭ দেশের রাষ্ট্রদূতদের বৈঠক থেকেও একই বার্তা আসার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করেন ভূরাজনীতি বিশ্লেষকরা।
কেননা, জুলাই-আগষ্ট পরিস্থিতিতে নেই বিশ্বের ভূ-রাজনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে যতটা ভালো সর্ম্পক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের, নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনের সঙ্গে ততটা খারাপ সর্ম্পক রয়েছে। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে ডোনাল ট্রাম্পের এক্সের বার্তায়।
গত ৩১শে অক্টোবর বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী রাত ১১টায় পোস্ট করা সেই টুইটটিতে তিনি বাংলাদেশ হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে লিখেছেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে কখনোই “এমনটি” ঘটতো না। কামালা হ্যারিস ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন “আমেরিকা ও সারা বিশ্বের হিন্দুদের উপেক্ষা করেছেন,” বলেন মি. ট্রাম্প।
তিনি “আমেরিকার হিন্দুদেরকে চরমপন্থী বামদের ধর্মবিরোধী এজেন্ডা থেকে রক্ষা” করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টুইটে বলেন, “আমরা তোমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়ব। আমার প্রশাসনের অধীনে আমরা আমাদের মহান অংশীদার ভারত এবং আমার মিত্র প্রধানমন্ত্রী মোদী’র সাথে সম্পর্ক আরও মজবুত করবো।”
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’র বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা অজানা নয়। এর আগেরবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণায় নরেন্দ্র মোদী সমর্থন করেছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গত কয়েক মাস ধরেই এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে, গত পাঁচই অাগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিন্দু অধ্যুষিত রাষ্ট্র ভারতের সম্পর্কে ভাটা দেখা দিয়েছে।
ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ই আগষ্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এরপর থেকে গণভবন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, সারাদেশে আওয়ামী লীগের কার্যালয়, নেতাকর্মীদের বাড়িতে লুট অগ্নিসংযোগ, মব জাস্টিসের মাধ্যমে গণ হত্যা পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, মন্দিরে হামলা, মামলার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেয়নি প্রতিবেশি ভারত। তার ওপর যুক্ত হয়েছে, জঙ্গীদের গণমুক্তি। ভারত মনে করে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের পরার্মশ ও সহযোগীতায় সেভেন সিস্টার্স খ্যাত বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যেকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শান্তিতে নেই ছাত্র-জনতা অভ্যূত্থানে ক্ষমতাসীন হওয়া আধা বিপ্লবী, আধা সাংবিধানিক পলিসিতে চলা দেশের বর্তমান সরকার। সদ্য নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্রমাগত চাপে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পৃথিবী ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে!
বিএন এ নিউজ,সৈয়দ সাকিব/এইচমুন্নী