বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংগঠিত তীব্র গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ওইদিন বিকেলে দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এ সময় তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবো।
ওই দিন রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছিলেন, “আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি”।
পরদিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করার কথা জানানো হয়। পরবর্তীতে গত ৮ আগস্ট শপথ নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এরপর দিন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে তার মা পদত্যাগ করেন নি। সেখানে তিনি বলেন, ‘মা কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। কারণ তিনি সে সময় পাননি।’
সেই সাক্ষাৎকারে জয় আরও বলেছিলেন, “বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে শুরু করলে, তখন পদত্যাগ করার সময় ছিল না। তিনি ব্যাগ গোছানোর সময়টুকুও পাননি। যতদূর জানি, সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’ সেই সময় জয়ের এই বক্তব্য দেশের মানুষ আমলে নেয়নি।
বিতর্কটা দেখা যায়, গত ১২ই সেপ্টেম্বর। ওইদিন শেখ হাসিনার একটি কল রের্কড ফাঁস হওয়ার পর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা দলীয় এক কর্মীর সাথে কথপোকথনের একটি অডিও কল রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়,” দেশ ছাড়ার আগে আমিতো প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করিনি। আমাদের সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেভাবে পদত্যাগ করতে হয় আমার কিন্তু সেভাবে পদত্যাগ করা হয় নি”।
তিনি আরো বলেন, আমি এখনো বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী”। ওই অডিও রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে আরও বলতে শোনা যায়, তিনি যেকোনো সময় বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারেন।
ফলে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে তোলপাড় শুরু হয় । পাড়ার চা দোকান থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। সবার প্রশ্ন একটাই, পালিয়ে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছিলেন কি না?
এর একদিন পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনার একটি পদত্যাগপত্র ছড়িয়ে পড়ে। দেশের অনেক গণমাধ্যমই ফলাও করে এটি প্রচার করে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে সেই পদত্যাগপত্রটি ভুয়া বলে দাবি করা হয়েছে।
এতকিছুর পরও কেন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্রটি গণমাধ্যমে উপস্থাপন করেনি? ফলে হাসিনার পদত্যাগপত্রের বিষয়টি ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
প্রশ্ন উঠেছে শেখ হাসিনা যদি সত্যিই পদত্যাগপত্র জমা না দেন, ভবিষ্যতে এটি নিয়ে কোন সংকট তৈরি হতে পারে কী না।
যদিও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে কোন সরকার প্রধানই ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করেন না। বিষয়টি স্টেট নেসেসিটি’ হিসাবে দেখছেন তারা।
সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না এই বিষয়ে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দিয়েছে কি দেয়নি , এটা বলার একমাত্র এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। তিনি যেহেতু ওই দিনই বলেছেন শেখ হাসিনা তার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন, সুতরাং এখন অস্বীকার করলেও পদত্যাগ কার্যকর হতে কোন বাঁধা নেই”।
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে কোন সরকার ব্যবস্থার কথা বলা নেই। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানে বলা না থাকলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান এক ধরনের কর্তৃত্ব নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির আদেশে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। যদিও বর্তমান সংবিধানে এমন কোনো বিধি নেই।
সংবিধানে না থাকলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে শপথ অনুষ্ঠানের আগে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়েছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সুপ্রিম কোর্ট মতামত দিয়েছে বলে ওই সময় বলা হয়।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ৫ই আগস্ট যে বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয়েছে ও পরবর্তীতে যে সরকার গঠন হয়েছে সেটি কোন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ মনে করেন, ভবিষ্যতে কখনো পরিস্থিতি ও সুযোগ তৈরি হলে আদালতে বিষয়টি উঠতেও পারে। ভবিষ্যতে যারা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করবে, তারা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারকে বৈধতা দিতে হবে সরকার গঠনের আগে। তাহলে এ নিয়ে কোন প্রশ্নের সুযোগ থাকবে না ভবিষ্যতে এমনটাই মনে করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।
যেমনটা হয়েছিল, ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় এবং ২০০৮ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদে। দ্বিতীয় সংসদে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বিএনপি সরকার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা সংক্রান্ত ইনডেমিনিটি বিলসহ সামরিক আইনের সব ফরমানের বৈধতা দিয়েছিল। একইভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার অষ্টম সংসদে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকাকালে যেসব কাজ করেছে তার বৈধতা দেয়।
অনুরূপভাবে আগামী ত্রয়োদশ সংসদে যারাই সরকার গঠন করুক না কেন, বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের সব ধরনের কর্মকান্ডকে বৈধতা দিতে হবে। অন্যথায় সবাইকে কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে বলে মনে করেন সংবিধান বিশ্লেষকরা।
বিএনএ,শামীমা চৌধুরী শাম্মী /এইচমুন্নী