বিএনএ ডেস্ক, ঢাকা: পাহাড়ের ঢাল কেটে তৈরি হয়েছে বাড়িঘর। দূর থেকে দেখলে পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বদলে জনবসতিই যেন চোখে পড়ে। বাংলাদেশের সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পাহাড় ধসের অনেক কারণের মধ্যে এমন জনবসতিও একটি। বৃষ্টি একটু বেশি হলেও গণমাধ্যমে পাহাড় ধসের খবর যেন নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর এইদেশে পাহাড় ধসের ঘটনা কম বেশি ঘটেই চলছে। যার কোনো প্রতিকার মেলেনি এখনো। প্রাণ দিতে হচ্ছে অনেক মানুষকে। বার বার এমন পাহাড় ধস কেন?
ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিতে আবার এসেছে জুন মাস। ২০০৭ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামের সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছর পার হয়েছে, তবে থামেনি পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল। বিচ্ছিন্ন দুই-এক বছর বাদ দিয়ে প্রতিবছরই কোনও না কোনোভাবে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটেছে। গত ১৫ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে প্রায় চার শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবু এই মৃত্যুমিছিল থামাতে প্রশাসনের চোখে পড়ার মতো কোনও উদ্যোগ নেই।
গত রাতে টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের দুটি স্থানে পাহাড় ধসে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। নগরীর আকবর শাহ থানার ১ নম্বর ঝিল এবং বিজয় নগর এলাকায় এ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। নিহতরা হলেন-শাহীনুর আক্তার (২৬), মাইনুর আক্তার (২৪), লিটন (২৪) ও ইমন (১৪)।
ক্ষতিগ্রস্ত হয় যারা-
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অভাবের তাড়নায় ছুটে আসা উদ্বাস্তু ও নিম্ন আয়ের লোকেরা সাধারণত এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বল্প আয়ের এসব লোক না পারে ভালো কিছু খেতে, না পারে কিছু করতে। মাথা গোজার ঠাঁইটুকুও করতে পারে না। অভাবের কারণে তাদের অনেক স্বাদ-আহ্লাদ থেকে যায়। যার ফলে তাদেরকে বসবাস করতে হয় পাহাড়ের চূড়ায় নয়তো রেল লাইনের পাশে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড়ের পাদদেশে খুপরি ঘর ভাড়া দেয় এলাকার কিছু চিহ্নিত লোক। তাদের কারণেই মূলত লোকজনের ঝুঁকি বাড়ছে। ঝুঁকিতে বসবাসকারী লোকজনদের সরিয়ে নিতে নির্দেশ কোনোভাবে মানা হচ্ছে না। পাহাড়ের পাদশে খুপরি ঘর বানিয়ে ভাড়া প্রদানকারী প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের নিয়ে নানা তথ্য মিলছে। পাহাড় বিক্রি করে এদের অনেকে বিপুল অর্থের মালিক।
অনেকের মতে, এদেশে পাহাড় ধসের মূল কারণ মানুষ। মানুষের অজ্ঞতাই এজন্য দায়ী। পাহাড়ের ঢালে বসতি গড়ে তুলছে মানুষ। পাহাড় কেটে কেটে বসবাসের জায়গা তৈরি করা হয়। যার ফল এই ধস আর মৃত্যু। তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের প্রশাসনও। প্রশাসনের দূর্নীতির কারণেই এই মানুষগুলো অবাধে সুযোগ পাচ্ছে এই মৃত্যুকুপে বসবাসের। আর পাহাড় নিয়ে ব্যবসা করছেন এদেশের বড় বড় নেতা- মন্ত্রীরা। পাহাড় কাটায় চিহ্নিত রাজনৈতিক নেতাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, ইটভাটা-মালিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত রয়েছে বলে সংবাদপত্রে অনেক খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রতিকার হয় না কোনো। দিব্যি মানুষ পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করছে আর প্রাণ দিচ্ছেন।
জিও সায়েন্স অস্ট্রেলিয়ার এক গবেষণায় বলা হয়, পাহাড় ধসের পেছনে প্রাকৃতিক কারণ এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। প্রাকৃতিক কারণ হলো— পাহাড়ের ঢাল যদি এমন হয় যে ঢালের কোনো অংশে বেশি গর্ত থাকে। তখন অতিবৃষ্টিতে ভূমি ধস হতে পারে। এছাড়া ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং পাহাড়ের পাদদেশের নদী ও সাগরের ঢেউ থেকেও পাহাড় ধস হতে পারে।
আর মনুষ্য সৃষ্ট কারণ হিসেবে গবেষণায় বলা হয়েছে, পাহাড়ের গাছপালা কেটে ফেলা, মাটি কাটা, পাহাড়ে প্রাকৃতিক খাল বা ঝর্ণার গতি পরিবর্তন, পাহাড়ের ঢালুতে অতিরিক্ত ভার দেওয়া। এছাড়া পাহাড়ে খনি খননের কারণেও ধস হতে পারে।
তবে ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে পাহাড়ের ভূপ্রকৃতি ও গঠন হলো বালি ও কাদা মাটির মিশ্রন। পাহাড়ের উপরিভাগে মোটা দানার বালির বিশাল স্তর, তার নিম্নভাগে রয়েছে কাদামাটির লেয়ার বা স্তর। এভাবে একটার পর একটা কাদামাটি ও বালির স্তরের উপর দাঁড়িয়ে আছে এদেশের পাহাড়গুলো। প্রবল বৃষ্টি মাটি বালির এই স্তরকে দূর্বল করে তোলে। যা এক সময় ধসে গড়িয়ে পরতে থাকে। আর যার কারণে ঘটে এই দুর্ঘটনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসেন বলেন, বর্ষা এলেই পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরানোর তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কার্যকর নয়। বর্ষায় কেন সরাতে হবে? দরকার স্থায়ীভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। নয়তো পাহাড় রক্ষা সম্ভব নয়।
চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিগত ১০ বছরে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার ছোট-বড় ১০টি পাহাড় ধস ও ভূমি ধসের ফলে অন্তত তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে।
২০১৫ সালে লালখান বাজার ও বায়েজিদ এলাকায় দেয়াল চাপায় এবং পাহাড় ধসে মা-মেয়েসহ ছয় জনের করুণ মৃত্যু ঘটে। ২০১৪ সালের নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে ৩ জনের মৃত্যু হয়।
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে খুলশী থানাধীন ইস্পাহানি মোড় এলাকায় পাহাড় ধসে এক গৃহবধূ মারা যান। একই বছর ২৯ জুলাই নগরীর লালখান বাজার এলাকার ট্যাংকির পাহাড় এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের করুণ মৃত্যু ঘটে।
২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর চার স্থানে পাহাড় ধসে ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১১ সালে চট্রগ্রাম নগরীর টাইগারপাসের বড় বাটালি হিল এলাকায় পাহাড় ধসে মাটি চাপায় একই পরিবারের ৫ জন সহ ১৫ জন মারা যান।
এর আগে ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকার ট্যাঙ্কির পাহাড় ধসে ১১ জনের মৃত্যু হয়।
আর ২০০৭ সালের ১১ জুন নগরীর কুসুমবাগ, কাইচ্যাঘোনা, সেনানিবাসের লেডিস ক্লাব সংলগ্ন লেবু বাগান, বায়েজিদ বোস্তামি, মতিঝর্ণা পাড়সহ সাতটি স্থানে পাহাড় ধসে মাটি চাপায় নিহত হন ১২৭ জন।
জানা যায়, ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর একটি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি পাহাড় ধসের ২৮টি কারণ উল্লেখ করে এটি প্রতিরোধে পাহাড়দুস্যদের চিহ্নিত করা, পাহাড়ে বসতি উচ্ছেদ করে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া, পাহাড় কাটা বন্ধ করাসহ ৩৬ দফার একটি খসড়া সুপারিশ প্রতিবেদন তৈরি করে।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্যমতে, চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে ২৫টি। এসব পাহাড়ে কম ও বেশি ঝুঁকিতে বসবাসকারী লোকজনের সংখ্যা লাখের ওপরে। বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের। এর মধ্যে ১৮টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের তালিকা করেছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। বাকি পাহাড়গুলোর তালিকা এখনও শেষ হয়নি।
বিএনএ নিউজ২৪/ এমএইচ