বিএনএ,চট্টগ্রাম: পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা একটি কনটেইনার জাহাজ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। ভারতের সংবাদ মাধ্যমে টেলিগ্রাফে সরাসরি জাহাজ আসার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে সরাসরি আসা কনটেইনার জাহাজে নিষিদ্ধ পণ্য আছে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর পাকিস্তান থেকে আসা জাহাজ নিয়ে নানা ধরনের তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ জাহাজটি কনটেইনার ভর্তি করে প্রচলিত পণ্য নিয়ে এসেছে। কনটেইনার নামানোর পর ফের কনটেইনার লোড করে ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। জাহাজটিতে দেশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের পণ্য নিয়ে আসা হয়েছে। এর মধ্যে আছে শিল্পের নানা ধরনের কাঁচামাল, পেঁয়াজ আলু ও গাড়ির যন্ত্রাংশ। চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্টরা এমনটাই নিশ্চিত করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগ জানায়, পাকিস্তানি জাহাজ থেকে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে (এনসিটি) মোট ৩৭০টি কনটেইনার (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে) নামানো হয়। জাহাজে করে পাকিস্তানের ১৮টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের ছয় হাজার ৩৩৭টি টন শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য নিয়ে আসা হয়। ১১৫টি কনটেইনারে আছে সোডা অ্যাশ, ৪৬টি কনটেইনারে খনিজ পদার্থ ডলোমাইট, ৩৫টি কনটেইনারে আছে চুনাপাথর। খালাস করা ছয় কনটেইনারে আছে ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট। ১০ কনটেইনারে আছে কাচ শিল্পের কাঁচামাল ভাঙা কাচ। এ ছাড়া ২৮টি কনটেইনারে আছে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল। মাত্র এক কনটেইনারে আছে গাড়ির যন্ত্রাংশ।
আইজিএমের তথ্য অনুযায়ী এসব পণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হলো আকিজ গ্লাস কারখানা, নাসির ফ্লোট গ্লাস, প্যাসিফিক জিন্স, এক্স সিরামিকস এবং স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। শিল্পের কাঁচামাল ছাড়াও ভোগ্যপণ্য ভর্তি বেশ কিছু কনটেইনার খালাস করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪২টি কনটেইনারে আছে ৬১১ টন পেঁয়াজ ও ১৪টি কনটেইনারে ২০৩ টন আলু। বিশেষায়িত কনটেইনার ভর্তি এসব পেঁয়াজ আলুর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ঢাকার হাফিজ করপোরেশন, এমআর ট্রেডিংস ও চট্টগ্রামের আল্লাহর রহমত স্টোর। পাকিস্তান ছাড়াও সেই জাহাজে করে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে খেজুর, জিপসাম, লোহার পুরোনো টুকরো, মার্বেল ব্লক, কপার ওয়্যার, রেজিন, হুইস্কি ও ভদকা আমদানি করা হয়েছে। হুইস্কি ভদকা ছিল একটি মাত্র কনটেইনারে। বাকি আমদানি পণ্যগুলো আছে একাধিক কনটেইনারে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বন্দর হয়ে জাহাজটি করাচি বন্দরে এসে পৌঁছে। এরপর করাচি বন্দর থেকে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে পৌঁছে গত ১০ অক্টোবর। গত ১১ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিতে ভেড়ার পর ৩৭০টি কনটেইনার জাহাজ থেকে ইয়ার্ডে নামনো হয়। এরপর জাহাজটি ইন্দোনেশিয়ার বন্দরের উদ্দেশে একটি পণ্যভর্তি কনটেইনারের পাশাপাশি দুই শতাধিক খালি কনটেইনার নিয়ে রওনা দেয়। লম্বায় জাহাজটি ১৮১ দশমিক ৯৯ মিটার। জাহাজটির ড্রাফট ৮ দশমিক ৫। বন্দরের ওয়েব সাইটে জাহাজটির পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠেেনর নাম লেখা ফিডার লাইন ডিএমসিসি। এর স্থানীয় শিপিং এজেন্ট রিজেন্স শিপিং লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি কর্ণফুলী লিমিটেডের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, আইজিএম (ইম্পোর্ট জেনারেল মেনিফিস্ট) সাবমিট করেই একটা জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। আবার বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষে আইজিএম ছাড়া যে কোনো দেশ থেকে জাহাজ বন্দরে আসতে পারে। তবে আমার মনে হয় জাহাজের পণ্যের আইজিএম দেখলে বোঝা যাবে কী ধরনের পণ্য আছে। আমার মনে হয় না এই জাহাজে স্বাভাবিক জাহাজে যেসব পণ্য বহন করা হয় তারচেয়ে ক্ষতিকর কিংবা আপত্তিকর কোনো পণ্য আছে। কাস্টম হাউসে ‘বিল অব এন্ট্রি’ দাখিল করলে জাহাজটির আমদানি পণ্য সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্ণফুলী লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেন, অন্য জাহাজগুলো যেভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নিয়ে আসে সে ধরনের আমদানি পণ্য নিয়েই পাকিস্তান থেকে জাহাজটি এসেছে। এই জাহাজে নিষিদ্ধ কোনো পণ্য থাকার বিষয়টি স্রেফ গুজব। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানি জাহাজ নিয়ে নানা অপতথ্য ছড়াচ্ছে। পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাধীনতার পর আসেনি এটা সত্য। তবে পাকিস্তান থেকে জাহাজযোগে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি রফতানি বন্ধ ছিল না। নিয়মিত পণ্য আমদানি হতো পাকিস্তান থেকে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তান থেকে সরাসরি কোনো জাহাজ আসেনি। স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময় পরে গেল ১০ নভেম্বর প্রথমবারের মতো কনটেইনার জাহাজ করাচি বন্দর থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এর আগে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আমদানি পণ্য ফিডার জাহাজের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর বন্দরে পৌঁছানো হতো। সিঙ্গাপুর বন্দর থেকে ছোট জাহাজে করে পাকিস্তানি আমদানি পণ্য নিয়ে আসা হতো চট্টগ্রাম বন্দরে। পাকিস্তান থেকে সরাসরি পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভেড়ার আগেও আমদানি প্রবাহ স্বাভাবিক ছিল। তখন সরাসরি আমদানির পরিবর্তে তৃতীয় দেশ ঘুরে চট্টগ্রাম বন্দরে আসত পাকিস্তানি পণ্য। অন্যদিকে করাচি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজটি ২৮৯টি কনটেইনার ভর্তি করে। এর মধ্যে একটি ছাড়া সব কনটেইনার ছিল খালি। জাহাজটি ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা কনটেইনার জাহাজটি পানামার পতাকাবাহী। জাহাজে কী পণ্য ছিল তা কাস্টমসে ‘বিল অব এন্ট্রি’ দাখিল করার পর জানা যাবে।
বিএনএনিউজ/ নাবিদ