বিএনএ, ঢাকা: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক দিন পরে ৬ আগস্ট ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর সংগঠক মাইকেল চাকমা। তুলে নেওয়ার প্রায় সাড়ে ৫ বছর পর তাকে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার একটি জঙ্গলে হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে রেখে যাওয়া হয়।
মাইকেল চাকমা বলেন, “আয়নাঘরে না থাকলে বুঝতে পারবেন না, সেই পরিবেশ কতটুকু অসহনীয়। মনে হবে, বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুও অনেক ভালো। বাঁচার আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম।” আয়না ঘরে থাকতেই আমি বাঁচার আশা একদম ছেড়ে দিয়েছিলাম। চিন্তা করতে পারি নাই, আমি আবার পৃথিবীর আলো দেখতে পারবো।
বন্দীদশা থেকে ফিরে জানতে পারেন পুত্র শোক বুকে নিয়ে তার বৃদ্ধ পিতা মারা গেছেন। মাইকেল চাকমা আর জীবিত নেই ধরে নিয়ে রীতি মেনে তার শেষকৃত্যও করেছে পরিবার।
গোপন বন্দীশালায় কাটানো দিনগুলোর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন মাইকেল চাকমা। ছেড়ে দেয়ার আগে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার রাতটিকে জীবনের অন্তিম সময় হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন মাইকেল চাকমা।
তিনি জানান, গত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে বেশ কয়েকটি গোপন কারাগারে তাকে রাখা হয়েছে। শুরুর দিকে জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। তাকে কোনো মারধর করা হয়নি। তবে যেভাবে একাকী বন্দি করে রাখা হয় এবং যে পরিবেশে রাখা হয় সেটি তার ভাষায় অত্যন্ত অমানবিক এবং ভয়ংকর রকমের মানসিক অত্যাচার। মাইকেল চাকমা আরও বলেন, ”মানুষ এভাবে বাঁচে না, এটাতো কবরের মতো। কোন জানালা নেই, কোনো আলো ঢোকে না, বাতাস ঢোকে না, শুধু চারিদিকে দেয়াল,” ।
আটকের প্রথম দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকার কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ডের বিপরীতে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকের সামনে থেকে আমাকে তুলে নেওয়া হয়। তুলে নেওয়ার পর তারা বলেছিল- আমাকে ধরার জন্য গত চার দিন ধরে ফলো করছে। আজ সফল হয়েছে।
চোখ বাঁধার আগে আমি গাড়িতে একটা ওয়াকিটকি দেখেছি, তখন তারা কাউকে ফোন করে বলে- মাইকেল চাকমা কট। কল্যাণপুর থেকে সরাসরি ওই জায়গায় আমাকে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। একটু এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে ওইখানে নেওয়া হয়। আমাকে তারা ধরে বিকাল ৫ টার দিকে। আর সেখানে পৌঁছায় সন্ধ্যায়। একদম নির্জন জায়গা। থানায় হাজতখানার মত লোহার দরজার ৭-১০ ফিটের মতো একটি রুমে আমাকে রাখা হয় এবং চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। এরমধ্যে আমাকে রাতের খাবার দেওয়া হয়। খাওয়ার পরে আনুমানিক রাত ৯ টার দিকে ৩-৪ জন লোক এসে চোখ বেঁধে একটি কালো টুপি পরিয়ে ওই বাড়ির আরেকটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে তারা বিশৃঙ্খল অবস্থায় একেক জন একেক প্রশ্ন করতে থাকে। আবার আগের রুমে নিয়ে আসা হয় আমাকে। চোখ খুলে দেয়, ঘুমানোর জন্য ২ টি কম্বল দেয়। এইভাবে ৯ এপ্রিল কেটে যায়।
দ্বিতীয় দিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে মাইকেল চাকমা বলেন, “পরের দিন ১০ এপ্রিল সকালে নাস্তা খাওয়ার পর আবার চোখ বেঁধে আরেকটি রুমে নেওয়া হলো। সেখানে নেওয়ার পর এবার চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। এরপর রাতের খাবার খেয়ে মনে হয় আমি ১৫-২০ মিনিট এর জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখন এক ব্যক্তি এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ বেঁধে কালো টুপি পরিয়ে দেয়।
গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরের-বাহিরের কোনও শব্দ যেন কানে না আসে সেজন্য স্পিকারে গান বাজিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মনে হলো গাড়িটি কোনো একটি গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। অনেক ভাঙা ও উচু-নিচু পথ দিয়ে গাড়ি চলছিল। এইভাবে এক ঘন্টার মত গাড়ি চলার পর একটা জায়গায় থামলো। তখন আমি জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম… মনে হলো নামিয়ে ক্রসফায়ার দেবে। তাই নেমেই উচ্চস্বরে স্লোগান দিতে লাগলাম। এরমধ্যে কখন যে আমাকে আবার গাড়িতে তোলা হয়েছে সেটাই বুঝতে পারি নাই। আবার কখন নামিয়ে ‘আয়নাঘরে’ ঢোকানো হল, কিছুই বুঝতে পারি নাই। এতটাই উত্তেজিত ছিলাম।
গত সাড়ে পাঁচ বছরে প্রায় ১০ বারের মত আমার রুম পরিবর্তন করে তারা। কয়েকটি ভবন একসঙ্গে লাগোয়া ছিলো। ভেতর দিয়ে আসা-যাওয়ার রাস্তা ছিল। টয়লেটের দরজায় একটি ছিদ্র ছিল, সেটি দিয়ে তারা ভেতরে দেখতে পেতো। টয়লেট ব্যবহার শেষ হলে চোখ বাঁধা অবস্থায় আবার হাতকড়া পরিয়ে কক্ষে দিয়ে যেতো। তারপর চোখ খুলে দেওয়া হতো।
আয়না ঘরের খাবার প্রথম দিকে কিছুটা ভালো ছিল বলে উল্লেখ করেন মাইকেল চাকমা। মাছ, মাংস ও ডিম থাকতো খাবারের মেন্যুতে। তবে, একটা সময় যখন সুপারভাইজারদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়, তখন আমাকে খারাপ খাবার দিতো। কখনও-কখনও বাসি ও নষ্ট খাবারও দিতো।
মাইকেল বলেন, যখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতাম, তখন ফ্যানগুলো বন্ধ করে দিতো। যেই ফ্যানটা দিয়ে গরম বাতাস হয় এবং শব্দ করে, সেটা ছেড়ে দিতো। এভাবে মাসের পর মাস আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আবার সকালে এসে উপহাস করে বলতো, ভালো ঘুম হয়েছে?
সেখানে না থাকলে বুঝতে পারবেন না যে সেই পরিবেশ কতটুকু অসহনীয়। ওখানে থাকার চেয়ে মৃত্যুও অনেক ভালো।
৬ আগস্ট গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয় বলে জানান মাইকেল চাকমা। বাথরুমে নেওয়া হলো। এরপর রুমে এসে পানি খেলাম। তখন দেখলাম একজন লোক হাতকড়া ও কালো টুপি নিয়ে আসলো। বললো- আপনাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। তারপর পেছনে হাত নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে এবং চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িতে তোলার পর মাথার টুপি খুলে দেওয়া হয়, গান চালিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করে।
ভোরে গাড়ি থামিয়ে জোরে-জোরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলের মধ্যে। তারপর তারা আমাকে শুয়ে পড়তে বলে। আধা ঘন্টার আগে উঠতে চেষ্টা করলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। বলে যায়, আধা ঘন্টা পরে উঠে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। তাদের কথা অনুযায়ী প্রায় আধা ঘন্টা পরে হাত খুললাম। দেখলাম গুলি করে না। তখন সাহস করে চোখের বাঁধনও খুললাম। পরে অনুমান করে রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর আসার পরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা ছিল মিরসরাই খড়ের হাট বন বিভাগ।
বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/এইচমুন্নী