।। মিজানুর রহমান মজুমদার।।
১৬ ডিসেম্বর ২০২১। মহান বিজয় দিবস। বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি হলো। আজ বাঙালি জাতির এক অনন্য গৌরবোজ্জ্বল দিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীর্ঘ ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাঙালি। জাতির পিতা মাত্র সাড়ে ৩ বছরে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করেন। ধ্বংস প্রাপ্ত রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রেললাইন, পোর্ট সচল করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেন।
১৯৭৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ অতিক্রম করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু “স্বল্পোন্নত’ দেশের কাতারে নিয়ে যান। ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ গত ১৩ বছর ধরে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে। ২০২১-২০৪১ মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে এবং ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। সরকার বিশ্বে প্রথম শত বছরের ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ বাস্তবায়ন শুরু করেছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর সুবিধা আজ শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত । প্রতিটি গ্রামে শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। দেশের সকল গৃহহীন-ভূমিহীনের জন্য ঘর তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। যাতে দেশের একটি মানুষও আর গৃহহীন না থাকে।
স্বাধীনতার সময় দেশের মাত্র ১৫ শতাংশেরও মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছেছিল আর ২০০৯ সালে এই হার ছিল ৪৭ শতাংশ। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে- আওয়ামী লীগ সরকার দেশের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার উচ্চবিলাসী স্বপ্ন দেখে।বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর পিতার দেখানো পথ ধরেই বিগত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে অবিশ্বাস্য উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছেন।
পাওয়ার সেল ডাটা অনুয়ায়ী, ২০০৯ সালে মাত্র ১.৮০ কোটি বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল আর বর্তমানে ৪.১৪ কোটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে।বর্তমানে দেশে ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপিত হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে পরিবেশ-বান্ধব নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৭৩০.৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা এসআরইডিএ’ল আওতায় দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানী উৎপাদনের সক্ষমতা ৭৩০.৩২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সোলার পাওয়ার বা সৌর বিদ্যুৎ থেকে আসছে ৪৯৬.৩৯ মেগাওয়াট।
সরকার সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে দুই কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুতের আওতায় নিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশের ৯৯.৭৫ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। স্বাধীনতার সময় এদেশের ১৫% মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র ৫০ বছরে এই অসামান্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ সালের ৫৪৩ মার্কিন ডলার হতে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২৫৫৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। আমরা দেশের প্রতিটি খাতে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছি। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প ব্যাবসা-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে ‘রোল মডেল’। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মর্যাদাশীল ‘উন্নয়নশীল’ দেশে উন্নীত হওয়ার জাতিসংঘের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে অগ্রসরমান এশিয়ার অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।
২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে জানায়, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ২৫তম অর্থনীতির দেশ হবে। এছাড়া অন্যান্য অর্থনৈতিক জরিপের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৪৩ সাল নাগাদ ২১তম শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ হতে যাচ্ছে।বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পর বহু ঘাত-প্রতিঘাত পার হয়ে আজকের বাংলাদেশের অবস্থান নিঃসন্দেহে গৌরবের।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে নির্দেশ করে দ্রুতগতিতে চলছে প্রবৃদ্ধি সঞ্চালক পদ্মা বহুমুখী সেতুসহ ১০ মেগা প্রকল্প ও একশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজ। সবকিছু ঠিক থাকলে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো (ইপিজেড) তৈরি হলে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রফতানি আয় সম্ভব হবে। একইসঙ্গে এই ১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশের এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
রাষ্ট্রের সেবা সমূহ যাতে মানুষ ঘরে বসে পেতে পারে সে জন্য সব কিছু অনলাইন ভিত্তিক গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি,সময়ের অপচয় হ্রাস পাচ্ছে। দেশ ৫জি প্রযুক্তিতে প্রবেশ করেছে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) চালু করা হয়েছে। ১,১১০টি ইউনিয়ন পরিষদে এবং ৩৪০ টি উপজেলা পরিষদে নেটওয়ার্ক সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে মোট ১৬৯০০ কি. মি. অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল স্থাপন হয়েছে।
স্বাধীনতার মহান বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকীতে সকল জাতীয় অর্জন ধরে রাখা,মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলা,স্বাধীনতার শত্রু ও হিংস্র ধর্মান্ধদের প্রতিহত করে উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে। বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর অঙ্গীকার হোক প্রতিটি মানুষের সকল অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবো।