বিএনএ ডেস্ক: দেশে জ্বালানি নিরাপত্তার অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রায় তিন হাজার ১৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি পাইপলাইন প্রকল্প। দেশের অভ্যন্তরে তেল পরিবহনের জন্য এটিই হবে প্রথম পাইপলাইন।
প্রকল্পেরই পাইপ দেখতে গত ১৪ এপ্রিল কানাডা যান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ। তার সফর সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী-পুত্র, দুই যুগ্ম সচিব, পদ্মা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পাইপ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দুই কর্ণধার।
তবে সরকারি আদেশ চার কর্মকর্তার কানাডা সফরের ব্যয়ভার পাইপ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বহন করে। এবং স্ত্রী-পুত্রের সফর ব্যয় বহন করেন বিপিসি চেয়ারম্যান নিজেই। সফর শেষে গত ২৫ এপ্রিল দেশে ফিরেছেন তারা।
বিপিসি চেয়ারম্যানের সফরসঙ্গী জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) ইলিয়াছ হোসেন জানান, কানাডার মতো দেশে পাইপলাইন স্থাপন প্রক্রিয়া কীভাবে করে সেটি দেখতেই মূলত সেখানে যাওয়া হয়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি সরবরাহ পাইপলাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদ্মা অয়েল কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মো. আমিনুল হক জানান, ‘প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। এরইমধ্যে বেশিরভাগ পাইপ কানাডা থেকে চলে এসেছে। বাকিগুলোও রয়েছে দেশের পথে।’
পাইপ ইন্সপেকশনের জন্য ৭-১৪ ডিসেম্বর আটদিন অথবা নিকটবর্তী সময়ে কানাডা সফরে ছয়জনকে অনুমতি দেয় সরকার। ছয়জনের মধ্যে ছিলেন, বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ, বিপিসি পরিচালক সৈয়দ মেহেদী হাসান, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান, পাইপ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ডস্টোন কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ডা. ওসমান গণি চৌধুরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর গণি চৌধুরী।
জিও আদেশের শর্তে উল্লেখ করা হয়, প্রথম চারজনের সফর ব্যয় বিল্ডস্টোন কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড বহন করবে। একই আদেশে বলা হয়, সফরে বিপিসি চেয়ারম্যানের স্ত্রী লায়লা মাসুদা এবং ছেলে সরওয়ার মোরশেদ কাদেরীও থাকবেন। তবে তাদের সফর ব্যয় নিজেরা বহন করবেন।
বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নৌপথে পরিবহন করা হয়। এ খাতে ট্রানজিট লসসহ কোটি কোটি টাকার সিস্টেম লস হয় বিপিসি’র। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে অয়েল ট্যাংকার ঢাকায় পৌঁছাতে সময়ও লাগে বেশি। সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন নির্মাণ করছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি তেল পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পে ২০১৫ সালের জুন মাসে সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করে বিপিসি। পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেডকে (ইআইএল) পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সবশেষ প্রকল্পটি পদ্মা অয়েল কোম্পানির তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এ প্রকল্পে পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ২৪৯ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে নারায়গঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত সাতটি স্টেশনসহ ২৪১ দশমিক ২৮ কিলোমিটার ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ ও গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত দুটি স্টেশনসহ ৮ দশমিক ২৯ কিলোমিটার ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ হবে। যেখানে এইচডিডি (উচ্চতর ডেটা স্টোরেজ) প্রযুক্তির মাধ্যমে ২২টি নদীর তলদেশে ৮ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন হবে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ১৯ উপজেলায় প্রকল্পের ২৮৪ দশমিক ৯২ একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লার বরুড়ায় স্থাপন হবে নতুন একটি ডিপো।
২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর প্রকল্পের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে পাঠানো ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারিত ছিল ২ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। পরবর্তীসময়ে কয়েক দফা সংশোধনী এনে ৫৩০ কোটি বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর ২ হাজার ৮৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকায় প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মাসখানেক পরই ওই বছরের ৫ নভেম্বর প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় সরকার।
সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্পের মাঝপথে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৫৯ দশমিক ২৩ কিলোমিটার ৬ ইঞ্চি ব্যাসের ভূগর্ভস্থ জ্বালানি পাইপলাইন নির্মাণকাজ ছাঁটাই করে বিপিসি। এতে খরচও কমে ৩ দশমিক ০২ শতাংশ। ফলে সংশোধিত ডিপিপির আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৫৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
২০২০ সালের ১৯ মে সংশোধিত ডিপিপির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। পরবর্তীসময়ে তৃতীয় দফায় আবারও সংশোধিত হয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বাড়ে ৪১৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সবশেষ গত ২২ জানুয়ারি তিন হাজার ১৭১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার এ মেগা প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৬৮৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
বিএনএ/এ আর