।।ডঃ অনুপম সেন।।
অধ্যাপক আহমদ হোসেনের আকস্মিক তিরোধান চট্টগ্রামের শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হল। তিনি চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম সিটি কলেজ- জন্মলগ্ন হতেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যে কয়েকজন ব্যক্তির নিরলস পরিশ্রমে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ গড়ে উঠেছিল। তন্মধ্যে তিনি অন্যতম। এক সময় সিটি কলেজটি আন্দরকিল্লার মোড়ে ছিল। পরে স্থানান্তরিত হয়ে আইস ফ্যাক্টরী রোডে চলে আসে। এই কলেজ-এর সূচনা লগ্নে অধিকাংশ শিক্ষকই প্রায় বিনা বেতনে শিক্ষা দান করতেন। শিক্ষকতা জীবনের প্রতি গভীর ভালবাসার কারণে তাঁরা এ কাজটি করতেন। আহমদ হোসেন শিক্ষকতা জীবনে ব্রতী হয়েছিলেন এই বৃত্তির প্রতি গভীর অনুরাগের বশবর্তী হয়েই। আমৃত্যু শিক্ষাই ছিল তাঁর প্রথম ভালবাসা।
১৯৬৪ সালে তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটে। যখন আমি সিটি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ, আমার কলেজ জীবনের শিক্ষাগুও অধ্যক্ষ রেজাউল করিম এর অনুরোধে বিনাবেতনে কিছুকালের জন্য অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করি। এম.এ. পরীক্ষা দিয়েই আমি সিটি কলেজে যোগ দিই এবং সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশের কিছুদিন পরে সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি বিজ্ঞান এর শিক্ষক হিসেবে সিটি কলেজে যোগদান করি। চট্টগ্রাম সিটি কলেজে তাই আমরা অবস্থান খুব দীর্ঘকালের ছিল না। কিন্তু এর মধ্যে অনেকের সঙ্গে গভীর সৌহার্দ্যরে ও সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ হই। আজও এঁদের অনেকের সঙ্গে আমার মনের সম্পর্ক খুবই কাছের, যদিও এখন আর তেমন দেখাশুনা হয় না। অধ্যাপক আহমদ হোসেন এঁদেরকেই একজন। তিনি আজ আর নেই। কিন্তু তাঁর স্মৃতি আমার অন্তরে অম্লান হয়ে রয়েছে।
১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে তিনি প্রায়ই আমার বাসায় আসতেন, এমনকি আমি না থাকলেও। আমার মাকে তিনি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন। বলতেন মাসিমার সঙ্গে কথা বলে আমার মন ভরে উঠে। আপনার চেয়ে তাঁর সাথে কথা বলে আমি বেশী আনন্দ পাই। মার কাছ থেকে তিনি চট্টগ্রাম শহরের পূরোনো দিনের কথা শুনতে খুবই ভালবাসতেন। মা-ও তাঁকে পেলে কিভাবে চট্টগ্রামে চা-খাওয়ার প্রচলন হলো, উদয় শঙ্কর চট্টগ্রামে এসে কোথায় নেচে ছিলেন, আগেকার দিনে চট্টগ্রামে আসা সার্কাস দলগুলোর নৈপূন্য ইত্যাদি অনেক কথা বলতেন।
তিনি অনেকবার আমাকে বলেছিলেন, মাসিমার কাছ থেকে চট্টগ্রাম শহরের এসব পুরোনো তথ্য জেনে নিয়ে লিখে রাখা উচিত। এই ঔচিত্যের কাজটি আমি করতে পারিনি। আজ মনে হয়, খুব একটা বড় ভুল করেছি। মাও আজ নেই। অধ্যাপক আহমদ হোসেনও লোকান্তরিত। ১৯৯৩ সালের ১৭ই জানুয়ারী মা যখন ইহধাম ত্যাগ করেন সেই সংবাদ পেয়ে অধ্যাপক আহমদ হোসেন ছুটে এসেছিলেন। তিনি “আজাদী” পত্রিকায় মা’র স্মৃতিচারণ করে অনবদ্য ভাষায় একটি অসাধারণ প্রবন্ধ রচনা করেন। এই প্রবন্ধটি আমার কাছে এক অক্ষয় সম্পদ।
অধ্যাপক আহমদ হোসেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তারে তাঁর একটি অগ্রণী ভূমিকা ছিল। চট্টগ্রামে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রয়াত বাদশা মিঞা চৌধুরীর অবদান অবস্মিরণীয়। অধ্যাপক আহমদ হোসেন বাদশা মিঞাকে এসব কাজে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। বিশেষত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করা, স্মারকলিপি দেওয়া প্রভৃতি নানাকাজ তিনি করেছেন বাদশা মিঞার সুযোগ্য সহকর্মী হিসেবে। আজকের চট্টগ্রামের তরুণ সমাজ এই সম্পর্কে কিছুই জানে না। অধ্যাপক আহমদ হোসেনের সবচেয়ে বড় কাজ আইস ফ্যাক্টরী রোডে চট্টগ্রাম সরকারী সিটি মহিলা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করা। চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি মহিলা কলেজ রয়েছে।
তাছাড়া চট্টগ্রাম কলেজ, মহসীন কলেজ, কমার্স কলেজ এবং সিটি কলেজেও মেয়েদের সহশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু মেয়েদের স্কুলের সংখ্যা খুবই কম। এই কলেজগুলোতে ছাত্রী যোগান দেবে কারা? প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা, তারপরই তো কলেজ শিক্ষা। আমরা সব সময় কোন বিষয়টিকে যে অগ্রাধিকার দেবো তা ভেবে পাই না। প্রায়ই ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়ে দিই। সিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে অধ্যাপক আহমদ হোসেন এই বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। নারী শিক্ষার প্রসারে যথার্থ আগ্রহী ছিলেন বলেই তিনি উর্দু ভাষাভাষীদের শিক্ষার নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী স্কুলের পরিত্যক্ত ভবনটিকে একটি মেয়েদের স্কুলে রূপান্তরিত করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে সিটি কলেজের অনেকের কাছ থেকে বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ, তাঁরা চেয়েছিলেন, এই পরিত্যক্ত ভবনটিকে সিটি কলেজের মহিলা শাখা করা এবং এ কাজটির ভার তাঁকেই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা মহিলা স্কুলে রূপান্তরিত করেন। এখানে তাঁর সুদূর প্রসারী দৃষ্টির পরিচয়। সিটি মহিলা স্কুলটি আজ একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারী মহিলা স্কুল, সেখানে প্রায় এক হাজার মেয়ে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে অধ্যাপক আহমদ হোসেন এর আগ্রহ যে কত গভীর ও তীব্র ছিল এ স্কুলটা তারই সাক্ষ্য বহন করছে। এটি তাঁর নশ্বর জীবনে অনশ্বর সৃষ্টি।
লেখকঃ উপদেষ্টা আওয়ামী লীগ, উপাচার্য্য, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।