বিএনএ ডেস্ক : মো. মাহফুজ আলম প্রকাশ মাহফুজ আব্দুল্লাহ। বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ইসাপুর গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থীকে ২৮শে আগস্টের আগে কেউ চিনতো না। অথচ এই মাহফুজ আলমই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের থিংক ট্যাংক বা পলিসি মেকার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দীর্ঘ ৩৬ দিনের আন্দোলনে কোথাও তার দেখা মিলেনি। দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ছিল অন্ধকারে। সবাই ব্যস্ত ছিলেন চেনামূখ ৬ সমন্বয়ককে নিয়ে। ৬ সমন্বয়ককে ডিবি হারুন আটক রাখা এবং আন্দোলন প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়ার ভিডিও গণমাধ্যমে প্রচার করেও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছন্দপতন করা সম্ভব হয়নি। বরং নতুন নতুন শব্দের মাধ্যমে ৯ দফার আন্দোলনের কর্মসূচীকে এক দফায় রূপান্তর করেছে এই মাহফুজ আলম। ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার পতন এবং অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পরও মাহফুজ আলম ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। কিন্তু বেশিদিন তিনি আড়ালে থাকতে পারেননি। ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী নিযুক্ত হন মো. মাহফুজ আলম। দেশ বিদেশের মিডিয়াগুলো তার ওপর নতুন করে আলো ফেলতে শুরু করে। বেরিয়ে আসে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির এই তাত্ত্বিক নেতার পরিচয়। ১৪ সেপ্টেম্বর রাত ৮টায় ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাস দেন। এতে মাহফুজ আলম তার ছাত্র জীবনের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং বর্তমানে তার অবস্থানের বিষয়ে পরিষ্কার করেছেন।
১০টি ধাপের দীর্ঘ এই স্ট্যাটাসে শুরুতে মাহফুজ আলম লিখেন ‘আমার কোনো ফেসবুক পেজ বা আইডি নেই, শুধুমাত্র এই আইডিটিই আমার। এটি এখন ভেরিফায়েড। যারা আমার নামে ভুয়া আইডি বা পেজ চালাচ্ছে, দয়া করে তাদের রিপোর্ট, আনফ্রেন্ড এবং আনফলো করুন।
এরপর মাহফুজ লিখেন, ভারতীয় গণমাধ্যম এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা সেল থেকে আমার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে, আমাকে ইসলামী বা সন্ত্রাসী রাজনীতির সঙ্গে, বিশেষ করে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা একটি ফ্রেমিং, যা ভারতীয় রাষ্ট্রের বয়ানকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে করা হয়েছে। আমি হিযবুত তাহরীরের মতাদর্শ এবং অন্য যে কোনো অগণতান্ত্রিক গোষ্ঠীর বিরোধিতা করেছি এবং এখনো করছি।
মাহফুজ বলেন, ‘আমি ইসলামী ছাত্র শিবিরের সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে তাদের প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, তবে তাদের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি আমার ভালো লাগেনি। আমি জামায়াতের ‘ইসলাম’কে অনুসরণ করি না এবং শিবিরের অন্যান্য কর্মীদের মতো কোনো বিশেষ সুবিধা পাইনি। বরং ক্যাম্পাসে ইসলামোফোবিয়া এবং শিবিরের ট্যাগের মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এরপর আমি মুজিববাদ, ইসলামোফোবিয়া এবং ইসলামপন্থী মতাদর্শের বিরুদ্ধে একাকী লড়াই করি। পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক স্টাডি সার্কেলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা গড়ে উঠেছিল, যা জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অংশ নিতে সহায়ক হয়।
চতুর্থ ধাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী বলেন, প্রকৃত অর্থে আমি কোনো ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলাম না, তবে ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমার সঙ্গে পরামর্শ করে এবং আমার অনুমোদনে নেওয়া হয়েছিল। ৯ দফা দাবিসহ প্রায় সব কর্মসূচি এবং বর্ণনাগুলো গত পাঁচ বছর ধরে আমার হাতে লেখা। আমার বা আমার কাছের মানুষদের কেউ যদি এই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে পারে, তবে সবকিছু আপনাদের সামনে প্রকাশিত হবে। দোয়া করুন আমরা যেন সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারি বা শহীদ হতে পারি।
মাহফুজ বলেন, ‘আমি একজন মুমিন এবং একজন বাঙালি মুসলিম। আমি ইসলামবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষবাদী মতাদর্শকে সমর্থন করি না। এই অঞ্চলে একটি সভ্যরূপে রূপান্তরিত রাষ্ট্র এবং সমবেদনা এবং দায়বদ্ধতা আদর্শের উপর ভিত্তি করে একটি সমাজের জন্য আমার একটি ভিশন আছে। নিপীড়িত বহুজনের ব্যক্তিগত ও যৌথ আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্রের নীতিতে অনুবাদ করার উপায় খুঁজে পাবে। ঢাকা হবে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের সভ্যতার মিলন ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল। ইনশাআল্লাহ!
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমি ইসলামাবাদ বা অন্য কোন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি বিরোধী নই। আমি মনে করি সম্প্রদায় এবং তাদের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি রাষ্ট্র গঠনে একটি সহ-অস্তিত্বীয় স্থান খুঁজে পাওয়া উচিত। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকল্প কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির জন্য জায়গা সীমিত করা উচিত নয়। কিন্তু, এই অভিব্যক্তিগুলিকে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের সঙ্গে এক করা উচিত নয়।
নিজের মতাদর্শ বলতে গিয়ে মাহফুজ আলম বলেন, আমি কঠোর অর্থে লালন ও মার্ক্স অনুসারী নই, তাই ফরহাদ মজহারের ইসলাম ও মার্ক্সবাদ ভার্সনের সদস্যতা করিনা। লালনকে আমি বাংলার প্রাণসন্ধানী অনুশীলন ও আচার-আচরণ হিসেবে দেখি। এবং, যতক্ষণ না পুঁজিবাদ অব্যাহত থাকবে ততক্ষণ মার্ক্স প্রাসঙ্গিক থাকবে। তবে বাংলা মুসলিমদের প্রশ্ন মূলত নদীমাতৃক ইসলাম ও বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের কাঠামোর মধ্যে উল্লেখ ও আলোচনা করা উচিত। বাঙালি মুসলমানদের উচিত নিকৃষ্টতম জটিলতার বেড়ি ভেঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বচিন্তা বিশ্বজগতে ব্যাখ্যা করা।
মাহফুজ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, আমি মাজার বা কবরের উপাসক নই, তবে বিভিন্ন তরিকার সুফি ও আলেমদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করি। কৈশোর থেকে অনেক আলেম ও পীরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল এবং এখনো আছে। তারা আমাকে প্রিয় নবীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা দিয়েছেন, আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে আপসকামী ও ফ্যাসিবাদকে সমর্থনকারী সুফিবাদ আমার পছন্দ নয়। আমি সেই সুফি ও আলেমদের ভালোবাসি যারা হকের পক্ষে দাঁড়ান। আমার মতে, কবর ধ্বংসকারীরা বাঙালি মুসলমানদের সাধারণ আকাঙ্ক্ষা ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের বিরোধী।
সৈয়দ সাকিব/হাসনা