বিএনএ, ঢাকা: ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও একাধিক মামলার পলাতক আসামি মুফতি শফিকুর রহমান দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। নাম পরিবর্তন করে মসজিদে ইমামতি করতে তিনি।
শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে কারওয়ান বাজার সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের মিডিয়া উইং এর পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব জানায়, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহতের ঘটনায় জড়িত শফিকুল ইসলাম। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের কাজও করতেন। এরপর আব্দুল করিম নামে ২০০৮ হতে নরসিংদীতে একটি মাদ্রাসায় আত্মগোপনে ছিলেন।
র্যাব জানায়, নরসিংদীর চরে একটি মসজিদে মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনে ইমামতি শুরু করেন মুফতি শফিক। ইমামতির আড়ালে তিনি মানুষকে ধর্মের নামে বিভ্রান্তিমূলক অপব্যাখ্যা দিতে। কৌশলে মাঝে মধ্যে ভিন্ন স্থানে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতেন। গত ২১ বছর তিনি এভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে ছিলেন।
খন্দকার মঈন জানান, এর আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম পলাতক আসামি জঙ্গি ইকবালকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তারই ধারাবাহিকতায় কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে মুফতি শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব জানায়, একমাত্র ছেলের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতেন শফিকুর রহমান। তবে দেখা করতেন নরসিংদীর বাইরে। ছেলের সঙ্গে দেখা করা ছাড়া তিনি নরসিংদীর বাইরে যেতেন না। তার ছেলেই দীর্ঘদিন র্যাবের নজরদারিতে ছিল।
খন্দকার মঈন জানান, সোমবার সন্ধ্যায় র্যাব খবর পায় মুফতি শফিক ছেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নরসিংদীর বাইরে গেছেন। এমন খবরে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে নজরদারি বাড়ায় র্যাব।
মঈন বলেন, তাকে মাদ্রাসা থেকে নয়, রাস্তা বা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা ছিল র্যাবের। কারণ, চরে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসামি বা জঙ্গি অভিযানে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার রাতে ছেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে সড়ক থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শফিকুর রহমানের পড়াশুনা
র্যাব জানায়, শফিকুর রহমান, ভৈরবের নিজ গ্রামে ৫ম শ্রেণি পাস করার পর মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে ঢাকার চকবাজারে একটি মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত হেদায়া পড়াশোনা করেন। ১৯৮৩ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) পাস করে দেশে ফেরেন
মুফতি হান্নানের সঙ্গে পরিচয়
১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে ইউসুফ বিন নুরি মাদ্রাসায় ফতোয়া বিভাগে ভর্তি হন শফিকুর রহমান। তিন বছরের ইফতা (ফতোয়া) কোর্স শেষ করেন। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে অবস্থানকালীন তিনি আফগানিস্তানে চলে যান এবং তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। এরপর ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে ঢাকার খিলগাঁওয়ের একটি মাদ্রাসায় খন্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচির নিউ টাউনে পড়ার সময় মুফতি হান্নানের সঙ্গে পরিচয় হয় শফিকুর রহমানের। পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তান গেলে সেখানে জঙ্গি সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি।
হুজির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুফতি শফিকুর
র্যাব জানায়, আফগানিস্তান থেকে দেশে এসে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা করেন। পরে ১৯৯০ সালে সমমনাদের নিয়ে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি হরকাতুল জিহাদের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি হরকাতুল জিহাদের আমির ও ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত হরকাতুল জিহাদের সুরা সদস্য ছিলেন।
শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা
র্যাব জানায়, ২০০১ সালে রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন। আহত হন আরও অনেকে। ওই ঘটনায় রমনা থানায় একটি হত্যা মামলাসহ অপর একটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়।
ওই হত্যা মামলায় ২০১৪ সালের ২৩ জুন ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। অপরদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলাটি বিজ্ঞ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন রয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে জনসভায় প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা হয়। ওই হামলায় ২৪ জন নিহত হন, আহত হন প্রায় তিন শতাধিক। ওই ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি হত্যা ও হত্যাচেষ্টার সহযোগিতাসহ দুটি পৃথক মামলা হয়। শফিকুর রহমান মতিঝিল থানার দুই মামলার পলাতক আসামি।
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরের বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহত। আহত হন শতাধিক লোক। শফিকুর রহমান কিবরিয়া হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি। এছাড়া শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় মোট ৬টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
বিএনএ/ এ আর