বিএনএ, ডেস্ক : সাম্প্রতিককালে ‘ডিপ স্টেট শব্দটি বেশ আলোচিত হচ্ছে। ‘ডিপ স্টেট’কে বাংলায় ‘ছায়া রাষ্ট্র’ বা ‘গুপ্তরাষ্ট্র’ বলা যেতে পারে। রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি সমান্তরাল রাষ্ট্র, সমসাময়িক রাজনীতি বিজ্ঞানে একে ‘ডিপ স্টেট’ নামে অভিহিত করা হয়। অর্থ্যাৎ ‘ডিপ স্টেট বা গুপ্তরাষ্ট্র হলো দৃশ্যমান সরকারের বাইরের বা পেছনের সরকার। অন্য কথায় ডিপ স্টেট বা ছায়া সরকার হচ্ছে এক গুচ্ছ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। ‘নির্বাচিত’ সরকারের পরিবর্তনের সময় একটি স্বল্পকালীন সরকার থাকে। তারা এই ডিপ স্টেট। এরাই নির্বাচন পরিচালনা করে এবং দৃশ্যত ক্ষমতা বদল করে।

ডিপ স্টেট কিন্তু পুরো সরকার নয়। এই ডিপ স্টেট নির্ধারণ করে কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতায় যাবে। ক্ষমতার পরিবর্তন হয় বলপ্রয়োগ ও বুদ্ধিচর্চার সমন্বয়ে। কখনো নির্বাচন, কখনো সংস্কার, কখনো গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার নামে ডিপ স্টেট কাজ করে। আবার স্বার্থ যখন রক্ষিত হয় তখন রাজতন্ত্রেও তাদের আপত্তি থাকেনা। যেমন সৌদি আরব!
মার্কিন অর্থনীতিবিদ ডেভিড রকফেলাকে ডিপ স্টেটের আধুনিক স্থপতি বা জনক বলা হয় । তিনি ১৯৭৩ সালে ৮৭ জন ধনী, ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে ট্রাইলেটারাল কমিশন তৈরি করেছিলেন। কমিশনের সদস্যরা ইউরোপ-আমেরিকার বিশিষ্ট ব্যক্তি।
নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এরা কাজ শুরু করেন। কমিশনের সদস্যদের কেউ কেউ আমেরিকা-ইউরোপে ক্ষমতায় গেছেন। যেমন জিবনিউ ব্রেজিনস্কি, যিনি প্রেসিডেন্ট ওবামার শিক্ষক ছিলেন। এই কমিশনের সদস্য লুকাস পাপাডোমস এবং মারিও মন্টি যথাক্রমে গ্রিস ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বুশ, ক্লিনটন, ডিক চেনি, আল গোরও এই কমিশনের সদস্য হিসেবে বিশ্বঅর্থনীতি এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন; এখনো করছেন।
মার্কিন কংগ্রেসের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মাইকেল লোফগ্রেন তার ‘দি ডিপ স্টেট: দি ফল অব দি কনস্টিটিউশন অ্যান্ড দি রাইজ অব শ্যাডো গভর্নমেন্ট বইটিতে বলেছেন, ” ডিপ স্টেটের সদস্যরাই নির্বাচনে সাহায্য করে; নির্বাচিতদের তথ্য দিয়ে তাদের নীতি ও কর্মপন্থা এমনভাবে নির্মাণ করিয়ে নেয় যেন অবশেষে তারাই এর ভোক্তা হতে পারে। অর্থাৎ এরা শাসন-শোষণ-নির্বাচন করে থাকেন নিজেদের জন্য, তবে অপরের নামে।
লোফগ্রেন দেখিয়েছেন, এরা মূলত জাতীয় প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা সংস্থা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ এবং অর্থ বিভাগের একাংশের সমন্বয়ে গঠিত। এরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের মাঝে গোপন ও স্বতঃস্ফূর্ত যোগাযোগ রক্ষা করে। বৈদেশিক মন্ত্রণালয়কে হাতের পাঁচ আঙুলের মতো ব্যবহার করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে ‘ডিপ স্টেট বলতে কেন্দ্রীয় সরকারের সদস্যদের, বিশেষ করে এফবিআই ও সিআইএর কর্মকর্তাদের গোপন নেটওয়ার্ককে বোঝানো হয়ে থাকে। গোপন এই নেটওয়ার্কে অনির্বাচিত সরকারি-বেসরকারি প্রভাবশালী লোকজন থাকেন। রাজনৈতিক সরকারের সমান্তরালে নিজেদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে স্বাধীনভাবে এই নেটওয়ার্ক কাজ করার চেষ্টা করে থাকে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এই ডিপ স্টেট সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রকাশ্য সরকারের পেছনে সিংহাসনে আসীন থাকে এক অদৃশ্য সরকার যার জনগণের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই ও আনুগত্যও নেই।’
ডিপ স্টেটের প্রধান অঙ্গ হলো গোয়েন্দা বাহিনী। এর বিস্তৃত ও বিশাল বর্ণনা পাওয়া যায় ট্রেভর আরনসনের বই ‘দি টেরর ফ্যাক্টর’। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডের চমৎকার বর্ণনা রয়েছে এ বইটিতে। ‘ম্যানুফ্যাকচারিং টেররিস্ট’ আলোচনায় ট্রেভর দেখিয়েছেন, কাউন্টার টেরোরিজমের নামে অবিশ্বাস্য কর্মকাণ্ড করা হয়ে থাকে কথিত এই ডিপ স্টেইটে।
এই ছায়ারাষ্ট্র নিজেদের প্রয়োজনে নানা অভাবিত ঘটনা পেছন থেকে ঘটিয়ে থাকে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নাইন ইলেভেন, লিবিয়ার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেন সরকারের ক্ষমতাগ্রহণ, পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাক্সে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারের পতন, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের ফলাফল বলে মনে করেন ভূরাজনীতি বিশ্লেষকরা।
ইদানিং ভূ-রাজনীতিতে এই ডিপ স্টেট বেশ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের ৫ই আগষ্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের ভূমিকা আছে —এমন বক্তব্যকে ঘিরে গত ৬ মাস ধরে বিশ্বরাজনীতিতে তোলপাড় চলছে।
বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মোদি প্রতিবেশী বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। পরবর্তী ওভাল অফিসে ট্রাম্প ও মোদি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এক সাংবাদিক ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকার বিষয়ে মোদির কাছে প্রশ্ন করেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’–এর ভূমিকা নিয়ে ট্রাম্পের কাছে প্রশ্ন করা হয়।
জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘বাংলাদেশে আমাদের “ডিপ স্টেটের” কোনো ভূমিকা ছিল না…এটা এমন একটা বিষয়, যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। স্পষ্ট করে বললে কয়েক শ বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। আমি বিষয়টি সম্পর্কে পড়ছি। তবে বাংলাদেশের বিষয়ে বলার ভার আমি প্রধানমন্ত্রীর মোদি ওপর ছেড়ে দেব।’
ট্রাম্পের এই কথার পর মোদি উত্তর দিতে শুরু করেন। তবে তিনি বাংলাদেশ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তিনি ইউক্রেন নিয়ে কথা বলেন। বাংলাদেশ ইস্যুতে মোদি- ট্রাম্প আলোচনা হলেও দুই নেতাই ‘ডিপ স্টেটের ভূমিকা নিয়ে মূখ খুলেননি। রহস্যটা এখানেই। যে ‘ডিপ স্টেটের’ মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে, সেই ডিপ স্টেটের মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পতন হবে কীনা তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা ।
বিএনএ/ সৈয়দ সাকিব,ওজি