বিএনএ,ডেস্ক : জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সব চেয়ে বড় ভূমিকা ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নামে ছাত্রদের একটি সংগঠনের। এই সংগঠনের পিছনে ছিল বিএনপি, জামায়াত ইসলামীসহ আওয়ামী লীগ বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী সংগঠন। লাখ লাখ ছাত্র জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মূখে টিকতে না পেরে ৫ আগষ্ট লৌহমানবী খ্যাত শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা হয়ে ওঠে জাতির সূর্য সন্তান। তারা যখন যা দাবি করেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা মেনে নিয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে ক্ষমতার মোহ পেয়ে বসে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা প্রথমে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করে। সেই জাতীয় নাগরিক কমিটি তিন মাসের মাথায় কমিটি ঘোষণা করে রাজনৈতিক দল গঠন করে। গণশক্তি নামে একটি খসড়া নামও প্রস্তাব করে রাখে। তারই ধারাবাহিকতায় তারা বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল এবং ‘জুলাই প্রক্লেমেশন’ দাবি করে।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর তারা শহীদ মিনারে সমাবেশের ডাক দেয়। কিন্ত প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এতে সাড়া দেয়নি, উল্টো জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়কদের ‘জুলাই প্রক্লেমেশন’র বিরোধীতা করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একাংশের সমর্থন থাকার পরও সমন্বয়করা বড় ধরনের হোঁচট খায় এবং ওইদিন ‘জুলাই প্রক্লেমেশন’ ঘোষণা থেকে বিরত থাকে। পরবর্তীতে তারা ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ নামে যেন-তেন একটি সমাবেশ করে নিজেদের আত্ম সম্মান রক্ষা করে। এই অবস্থায় ‘জুলাই প্রক্লেমেশন’ ও নতুন দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা সারাদেশ সফর করে সমাবেশ করার পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ করার কর্মসূচি ঘোষণা করে।
তারই ধারাবাহিকতায় ১১ জানুয়ারি বিকেল তিনটায় চট্টগ্রাম নগরীর বিপ্লব উদ্যান এলাকায় ‘জুলাই প্রক্লেমেশন’র পক্ষে পথসভা, জনসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ এবং সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ। পরে তারা পথসভায়ও বক্তব্য রাখেন।
বিকাল সাড়ে চারটার দিকে ওয়াসা মোড়ের একটি ভবনের পঞ্চম তলায় একটি অফিসে যান মাসুদ-রাসেলসহ তাদের কয়েকজন সমর্থক। এর কিছুক্ষণ পর রেজাউরের নেতৃত্বে ডট গ্যাংয়ের ১০-১২ জনের একটি দল ওই অফিসে যায়। এ সময় সহ-সমন্বয়ক রেজাউর কেন্দ্রীয় নেতা মাসুদের কাছে কৈফিয়ত চেয়ে বলেন, ‘আজকের প্রোগ্রাম সম্পর্কে আমাদের জানান নাই কেন?’ জবাবে মাসুদ বলেন, ‘চট্টগ্রামের সমন্বয়ক দুজনকে জানিয়েছি। আপনাকে কেন জানাবো? হু আর ইউ?’
এ সময় রেজাউর এবং তার সঙ্গে থাকা ডট গ্যাংয়ের সদস্যরা আব্দুল হান্নান মাসুদ, মাহিন সরকার, রিফাত রশীদ ও রাসেল আহমেদকে প্রায় এক ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে রাসেল এবং তার অনুসারীরা মিছিল নিয়ে জামালখানে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এসে সংবাদ সম্মলেন করে। এ সময় দলবল নিয়ে সেখানে ঢোকেন খান তালাত মাহমুদ রাফি ও রেজাউর রহমান। উভয গ্রুপ তর্কে জড়ায় এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়।
জুলাইয়ের আন্দোলনে আহত হয়েছেন— এমন দাবি করে স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে আসা একজন এ সময় রাফি ও রেজাউরের সঙ্গে অবস্থান নেন। কিন্তু রাসেলের অনুসারীরা দাবি করেন, ওই ছেলে আহত হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে তারা গত ৫ই আগস্ট বিজয় মিছিলের একটি ছবি দেখিয়ে দাবি করেন, ‘স্ক্র্যাচ ছাড়াই ওই ছেলে সেদিন মিছিলে অংশ নেয়। তাহলে তিনি আহত হলেন কখন?’ তারা ওই ছেলের মেডিকেল পরীক্ষা করানোরও দাবি জানান।
এই অবস্থায় পন্ড হয়ে যায় সংবাদ সম্মেলন। পরবর্তীতে প্রেসক্লাবের নিচে দুই সমন্বয়ক গ্রুপ সমরনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রায় ৪০ মিনিট লাঠিহাতে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিত শান্ত করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঢাকাভিত্তিক দুটি অংশ চট্টগ্রামে দুটি গ্রুপকে সমর্থন দিচ্ছে। এর মধ্যে খান তালাত মাহমুদ রাফি ও রেজাউর রহমানের অংশটিকে সমর্থন দিচ্ছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদের সমর্থন পাচ্ছেন রাসেল আহমেদ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র রাসেলই স্থান পেয়েছেন।
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় চট্টগ্রামের যেসব এলাকায় ছাত্র-জনতা জড়ো হন সেখানে সড়কবাতি বন্ধ রাখার অভিযোগে গত বছরের ১৪ই আগস্ট সাময়িক বরখাস্ত করা হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ উপবিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশকে। ২৬শে সেপ্টেম্বর ঝুলন কুমার দাশকে রংপুর সিটি কর্পোরেশনে বদলি করা হয়। এর মধ্যেই গত ১৮ নভেম্বর সিটি কর্পোরেশনের ‘উন্নয়নের প্রয়োজনে’ ঝুলন দাশকে আবার চট্টগ্রামে ফিরিয়ে আনার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবরে চিঠি লিখেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
অভিযোগ আছে, ঝুলন কুমার দাশসহ দুই প্রকৌশলীকে ফিরিয়ে আনতে তদবির করেন সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি। কিন্তু বেঁকে বসেন আরেক সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ। তার অনড় অবস্থানের কারণে গত ১৭ ডিসেম্বর ঝুলন দাশকে চাকরি থেকে পুরোপুরি অপসারণ করা হয়।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে মেলার আয়োজন করতে যাওয়া এক নারী উদ্যোক্তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রেজাউর রহমানের বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ সংক্রান্ত ৬ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের একটি কল রেকর্ড ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রুহুল আমীন তরফদারের প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেককে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের চুক্তি নবায়নে সহযোগী হিসাবে কাজ করেছে সমন্বয়ক রাফি ও রেজাউর। এছাড়া নতুন ব্রিজ থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত বালির ব্যবসা বণ্টন সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদাবাজির সঙ্গেও জড়িত তাদের সিন্ডিকেট। তবে রাফি ও রেজাউর দুজনেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তাদের জনপ্রিয়তায় ক্ষুদ্ধ হয়ে ফ্যাসিস্টদের দোসররা অপপ্রচার চালাচ্ছে।
শামীমা চৌধুরী শাম্মী