বিএনএ, কক্সবাজার: অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূল অতিক্রম করছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড়টির মূল কেন্দ্র বাংলাদেশ সময় দুপুর ৩টায় মিয়ানমারের ইউকপিও বন্দরের সিতওয়ে অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করেছে। ঘূর্ণিঝড়টি শক্তি হারিয়ে বর্তমানে স্থল নিম্নচাপ হিসেবে অবস্থান করছে। মোখার তাণ্ডবে কক্সবাজারে ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফের সেন্টামার্টিনেই ক্ষতি হয়েছে ১২০০ ঘরবাড়ি। এছাড়া অসংখ্য গাছপালা উপড়ে গেছে।
রোববার (১৪ মে) সন্ধ্যায় এই তথ্য জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। তিনি বলেন, মোখার তাণ্ডব সন্ধ্যা ৭টার পর পুরোদমে শিথিল হয়ে যাবে। সিগন্যাল কমে এলে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা আড়াই লাখ মানুষ ঘরে ফিরতে পারবেন।
এরআগে বিকেল ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মোখা। বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা আবহাওয়া অফিসের প্রধান আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান বলেন, ‘বিকাল ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়টি। এতে সেসব এলাকার ঘরবাড়ি, গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ভেঙে গেছে।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, এই মুহূর্তে সেন্টমার্টিনে বাতাসের গতি থেমে গেছে। তবে বাতাসের কারণে ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। দ্বীপের গাছপালা বাড়িঘর ও রাস্তার উপর এলোপাতাড়ি হয়ে পড়ে থাকায় স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে আসতে শুরু করেছে। অনেক ঘরবাড়ি উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আহত হয়েছে এক নারীসহ তিনজন।
সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা ইউপি সদস্য আবুল ফয়েজ বলেন, বাতাসের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর ছিল। মানুষের ঘরবাড়ির টিন, ছাউনি, কাঠ, বাঁশ উড়িয়ে নিয়েছে। বড় বড় গাছ ও নারিকেল গাছ দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে। দোকানপাট ভেঙে উড়ে গেছে। পুরো সেন্টমার্টিনে বৃষ্টির পানি ও বাতাসের তীব্রতায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব ধোঁয়াশা হয়ে আছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখা মূল আঘাত মিয়ানমারে চলছে। যে কারণে বাংলাদেশের জন্য অনেকটাই ঝুঁকি কেটে গেছে। কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারি আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা টেকনাফ থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরত্বে দক্ষিণ মিয়ানমারের সিট্যুয়ে অঞ্চল দিয়ে চলে গেছে।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের মূল ঝুঁকিটা চলে যাবে মিয়ানমার অঞ্চল দিয়ে। টেকনাফ, কক্সবাজারসহ বাংলাদেশের অঞ্চলগুলো অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত । এর ফলে শুরু থেকে ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে আমাদের যে ঝুঁকির সম্ভাবনা ছিল, এখন আর ততটা ঝুঁকি নেই।
তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার পিক আওয়ার ছিল দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত । এ সময়ে দ্রুত বেগে জলোচ্ছ্বাস প্রবাহিত হয়েছে। তখন ঘণ্টায় ১২০-১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়া ছিল।
আবহাওয়াবিদ বলেন, বিকেল নাগাদ ঘূর্ণিঝড় মোখা আমাদের অতিক্রম করে গেলেও এর প্রভাব থেকে যাবে আরও দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত। আর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরিলক্ষিত হবে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে। তবে পর্যায়ক্রমে তা কেটে যাবে। এরপর শুরু হবে ভারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত।
এদিকে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, তীব্র বাতাসে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে ৮০ শতাংশ কাঁচাঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। গাছপালা পড়ে কোনো কোনো এলাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ ছিল। তবে ঝড়ের গতি কমে আসলে গাছপালা সরানো হয়। বর্তমানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান জানান, শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া রামু ও উখিয়ার উপকূলে ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। তবে কোথাও ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়নি।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমদ জানান, শুষ্ক মৌসুমে জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের ৫৯৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সুরক্ষিত করা হয়েছে। কারণ চলতি অর্থ বছরে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর, টেকনাফে ৩২ কোটি টাকার জরুরি ভিত্তি তে বাঁধের মেরামত করা হয়েছে। এবার ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে ৪/৫ ফুট জলোচ্ছ্বাস হলে ও টেকসই বেড়িবাঁধ থাকায় কোন এলাকায় পানি ঢুকতে পারেনি।
ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রধান বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় তিন লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সরকারিভাবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখন পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার মানুষ এসেছে। এর বাইরেও বিভিন্ন স্থানে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সব মিলিয়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছেছে।
সর্বশেষ জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যানুয়ায়ী ৬৩০ টি আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে আড়াই লাখ লোক নিজ নিজ বাসস্থানের উদ্দেশ্যে আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
মোখার কেন্দ্র মূলত মিয়ানমানের রাখাইন রাজ্য, সেখানেও তাণ্ডব চালাচ্ছে। রাজ্যের সিটুই জেলার লোকালয় ইতোমধ্যে ৮ থেকে ১০ ফিটের মতো জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে।
বিএনএ/ফরিদুল, এমএফ