বিএনএ, চট্টগ্রাম: সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা আনোয়ারার তিনজন ও কর্ণফুলীর একজনের পরিবারের দিন কাটছে চরম উদ্বেগ–উৎকন্ঠায়। বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিকের মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ৩ ও কর্ণফুলী উপজেলার ১ জন নাবিক রয়েছে।
জিম্মি দশার খবরের পর থেকে আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দরের বাসিন্দা গাজু মিয়ার ছেলে সাজ্জাদ হোসেন (৩০), মধ্য বন্দরের মৃত আয়ুব আলীর ছেলে শামসু উদ্দীন শিমুল (৩৫) ও বদলপুরা গ্রামের আক্তার উদ্দীনের ছেলে আসিফুর রহমান (২৪) এবং কর্ণফুলী উপজেলার নুর উদ্দিনের পরিবারে চলছে আহাজারি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মো. সাজ্জাত হোসেন (৩০) এর মা শমসাদ বেগম দিনভর আহাজারি করছিলেন, আল্লাহ আমার ছেলেকে আমার কোলে ফিরিয়ে দাও, আল্লাহ তুমি রহমানুর রহিম, আমার ছেলে আমার কাছে ফেরত দাও, আল্লাহ আমারা বড় আশা করে আমার আত্মীয়ের মেয়েকে ছেলের বউ বানাবো বলে কাবিন করেছি। ওই মেয়ের উছিলায় হলেও আল্লাহ আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও।
তাদের বাড়ি আনোয়ারা বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দর এলাকায়। পরিবারের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সাজ্জাদ তৃতীয়। দীর্ঘ তিন মাস ছুটি শেষে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জাহাজে ফিরে যান তার আগের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি আত্মীয়ের এক মেয়ের সাথে সাজ্জাদের বাগদান হয়। ফিরে এসে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে বিয়ের অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। বিষয়টি জানান সাজ্জাদের ছোট ভাই মাকসুদ মিয়া।
বড় ভাই মোস্তাক মিয়া বলেন, মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় সাজ্জাদ ফোন করে জানায়, জলদস্যুরা আমাদের অস্ত্র নিয়ে জিম্মি করেছে। জানিনা কি হয়। আমার জন্য দোয়া করবেন। এরপর আর একবার কথা হয়। সর্বশেষ ছয় টা ৪৫ মিনিটে একটা ভয়েস মেইল দিয়ে জানায়, হয়তো আর কারো সাথে কথা হবে না, ওরা আমাদের মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। আমার জন্য দোয়া করবেন।
সাজ্জাদ হোসেনের পিতা গাজু মিয়া জানান, সারা জীবন দিনমজুর কাজ করে ৫ সন্তানকে শিক্ষিত করেছি। তাদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। মহান আল্লাহ যেন আমার ছেলেকে আমার বুকে ফেরত আনে। আমি সবার দোয়া এবং সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। জলদস্যুদের হাতে জিম্মির মধ্যে বন্দরের শামসু উদ্দীন শিমুল (৩৫) এর পরিবারে চলছে কান্নার রোল। তার স্ত্রী রীমা ও তিন কন্যা আর্তনাদ থামানোর কেউ নেই।
শিমুলের ভগ্নিপতি বদরুল হক জানায়, জলদস্যুরা জিম্মি করার পর দুপুর দুইটায় আমার শ্যালক শিমুল আমাকে ফোন করে ঘটনাটি বলেন। আপাতত ঘরে না জানার জন্য নিষেধ করলে পরবর্তীতে বিকেল ৪ টায় সে নিজেই স্ত্রী রিমা আক্তার কে ফোন করে জলদস্যু তাদের জিম্মি করেন বলে জানায়। এই খবরে তার স্ত্রীও পরিবারের মেয়েরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শিমুলের পরিবারে দুই ভাই দুই বোন ছাড়াও স্ত্রী ও তার তিন কন্যা সন্তান রয়েছে।
বদলপুরা গ্রামের আসিফুর রহমানের পিতা আক্তার উদ্দীন বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগে আসিফ আমাদের ফোন করে জানায় তাদের জাহাজটি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। জলদস্যুরা তাদের জিম্মি করেছে। যে কোনো সময় তারা ফোন নিয়ে ফেলবে হয়তো আর কথা হবে না। আমার জন্য দোয়া করবেন। এই কথা বলে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। আসিফের জন্য তার পুরো পরিবারের চলছে আহাজারি। তিনি আরো বলেন, বুধবার আমরা অভিভাবকেরা সবাই কোম্পানির মালিকের কাছে গিয়েছি। তারা আশ্বাস দিয়েছে আমাদের সন্তানদের মুক্তির সব ব্যবস্থা করবেন।
পার্শ্ববর্তী কর্ণফুলী উপজেলার জাহাজে থাকা আরেকজন নাবিক নুরু উদ্দীনের মা ইসলাম খাতুন জানান, সন্তানের সাথে শেষ কথা হয়েছে কাল সন্ধ্যায়। এসময় ছেলে ফোনে বলে, তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নিচ্ছে দস্যুরা। সবাইকে দোয়া করতে বলে। এরপর আর কথা হয়নি। এদিকে সকালে জাহাজটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান কেএসআর এম অফিসে যোগাযোগ করতে ছেলের স্ত্রী ও স্বজনরা গেছে। এখন শুধু একটাই চাওয়া কলিজার সন্তানকে সুস্থভাবে ফিরে পাওয়া।
নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস শিমু বলেন, সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে আমার সাথে স্বামীর কথা হয়। তখন কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, জলদস্যুরা মোবাইল নিয়ে ফেলবে। জাহাজ জিম্মির খবর যেন অফিসে জানাই। আর অফিসের সাথে যেন যোগাযোগ করি। এর আগে মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টার দিকে জলদস্যুরা জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নেয়। চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের এই জাহাজ পরিচালনা করছে গ্রুপটির সহযোগী সংস্থা এস আর শিপিং লিমিটেড।
বিএনএনিউজ/ বিএম